সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“পুলিশকে বলব, মাইকিং করতে। ইন্ডিয়ার লোকেরা এপারে চলে আসুন, বাকিটা প্রশাসন দেখে নেবে।” এভাবেই আজ মালদহের প্রশাসনিক সভা মঞ্চ থেকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানকার ভারতীয়দের দেশে ফেরার আহ্বান জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব যাদের, তাঁরাই নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে! চলতি মাসের গোড়ার দিকেই বিএসএফের বিরুদ্ধে এই বড় অভিযোগ এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়। আজ, মালদহের ইংরেজবাজারের সরকারি পরিষেবা বিতরণের অনুষ্ঠান থেকে ফের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, ‘ওপার বাংলায় একটু সমস্যা হচ্ছে। সীমান্ত দেখার দায়িত্ব বিএসএফের। কিন্তু কোনও অন্যায় হলে আমরা দেখে নেব। আপনারা মনে রাখবেন, বিএসেফের সঙ্গে ওদের বচসা হলে, গ্রামের লোকেরা সেখানে যাবেন না।’
এর পরে তাঁর সংযোজন, ‘হয়তো আমাদের সম্পর্ক একদিন ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু দেখতে হবে, তার আগে কোনও সমাজবিরোধী বা জঙ্গি যেন এপার বাংলায় কোথাও ভাড়া নিয়ে বাসা না বাঁধে। কোনও ঘুঘুর বাসা যেন না হয়। তখন সেটা সমাজের ক্ষতি, রাজ্যের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। উন্নয়ন তখনই হয়, যখন শান্তি থাকে।’
এদিনের সভায় মালদহের সীমান্ত নিয়ে অন্য কথাও বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘বিহার, ঝাড়খড, বাংলাদেশের বর্ডার এই মালদহ। ফলে প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে অনেক বেশি। কেউ কোনও গুন্ডামি যেন না করতে পারে।’
পাশাপাশি তাঁর কথায় ‘মালদহ বা গৌড়বঙ্গ আগে উত্তরের দুয়ার বা গেটওয়ে বলে পরিচিত ছিল। এখানে কেউ ব্যবসা করলে গোটা উত্তরবঙ্গ সুফল পাবে। তাই আমরা আপনাদের জন্য মালদহকে শিল্পনগরী করে গড়ে তুলেছি। আরও ব্যবসা করুন, আরও ঢেলে সাজান। মনে রাখবেন, একটা ব্যবসা করলে ১০টা মানুষকে সাহায্য করা হবে।’
উত্তরবঙ্গ সফরে বেরিয়ে প্রথম দিনই মালদা পৌঁছান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমে তিনি মালদা পৌঁছান, এর পর মঙ্গলবার ইংরেজবাজারের সভায় যোগ দেন তিনি। একাধিক ঘোষণার মাধম্যে এদিনের সভা শেষ করেন মুখ্যমন্ত্রী। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শুরু করে বাংলার বাড়িসহ নানা বিষয়ে তিনি বলেছেন এই সভায়।
এদিনের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, ”যতদিন বাঁচবেন ততদিন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা পাবেন। এটা মা বোনেদের ভান্ডার। এই ভান্ডার উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। ওদের পড়তে দিন। দেখবেন মেয়েরাই একদিন সংসার চালাবে।”
সঙ্গে আবাসের টাকা নিয়ে কেন্দ্রকে তোপ দাগিয়ে তিনি বলেন, ”কেন্দ্রীয় সরকার ঘরের টাকা দেয়না। তা সত্বেও ১২ লক্ষ পরিবারের কাছে টাকা দিয়েছি। আরও ১৬ লক্ষ পরিবারকে দেওয়া হবে। বাড়ি নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে। আগামী দেড় বছরে বাড়ি হবেই নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা যা বলি তাই করি।”
আর মঙ্গলবার ইংরেজবাজারে সরকারি পরিষেবা প্রদান অনুষ্ঠান মঞ্চে দুলাল সরকারের ছবি রেখে ‘স্বজনহারা’র শোক নিয়েও হুঁশিয়ারির সুরে বললেন, ”সমাজে মাফিয়াদের কোনও স্থান নেই। যারা সন্ত্রাস ছড়ায়, তাদের কোনও জায়গা নেই। দুলাল সরকার, যাকে আমি বাবলা বলে চিনি সেই ছাত্র রাজনীতির সময় থেকে, তাকে হারানো মানে আমার স্বজনকে হারানো। ওর পরিবারের পাশে আমি, আমরা আছি। ওর স্ত্রী চৈতালি এখানে আছে। ওকে বলব, মন ভেঙো না। দুলালের অসম্পূর্ণ কাজ তুমি সম্পূর্ণ করো।”
পাশাপাশি সরকারি কাজে স্বচ্ছতা আনতেও এদিন মুখ্যমন্ত্রী মালদহের জনসভা থেকে বিডিওডের নির্দেশ দেন, ‘ সরকারি কাজে স্বচ্ছতা এবার থেকে বিডিওডের সপ্তাহে একদিন করে গ্রামে যেতে হবে, এবং গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে ‘। শুধুমাত্র বিডিওদের সতর্ক করাই নয়, কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে সরব হন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, ‘কেন্দ্র আমাদের ১ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকা দেয়নি। কোথা থেকে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে? কিন্তু আমরা কাজ থামিয়ে রাখিনি। কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী – সব প্রকল্পেই আমরা কাজ করছি ‘।
অন্যদিকে, রাজ্যের চালু করা ওবিসি সার্টিফিকেট গত বছর বাতিল করে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। আদালতের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য। তবে মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকার কারণে রাজ্যের কয়েক লক্ষ তরুণ তরুণীর চাকরি আটকে রয়েছে বলে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন মালদহের ইংরেজ বাজারের সরকারি পরিষেবা অনুষ্ঠান থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যারা ওবিসিতে আছেন, তাদের একটু কষ্ট হচ্ছে। কোর্টের একটা রায়ে সব আটকে গেছে। মনে রাখবেন, আমরা কিন্তু থেমে নেই। সুপ্রিম কোর্টে আমরা বড় বড় আইনজীবী দিচ্ছি। কারণ, কোর্টের এই রায়টা বেরোনোর পর আমাদের অনেক চাকরি আটকে গেছে। যতক্ষণ এগুলো না হচ্ছে আমি চাকরি দিতে পারছি না।”
সরকারি চাকরিতে ওবিসিদের জন্য ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করেছিল রাজ্য। যা নিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় রাজ্যের সংরক্ষণ নির্দেশ বাতিল করে হাইকোর্ট জানিয়েছিল, ‘ধর্মের ভিত্তিতে কোনও সংরক্ষণ করা যায় না’। এ প্রসঙ্গে মমতা এদিন বলেন, “মনে রাখবেন জেনারেল কাস্টের কোটা কেটে আমি ওবিসিদের জন্য ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করিনি। এজন্য এক্সট্রা টাকা দিয়ে এক্সট্রা সিটের ব্যবস্থা করেছি।”
মমতা বলেন, চিন্তা করার বা হতাশা হওয়ার দরকার নেই। একটা চায়ের দোকানে চা, বিক্রি, ঘুগনি বিক্রি করলেও ইনকাম খারাপ হয় না, চাকরির থেকে বেশি টাকা পাওয়া যায়। মনে রাখবেন, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। কেউ চাকরির সুযোগ পেলে করবেন। ইতিমধ্যে পলিটেকনিক ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আমরা ১০ লক্ষ ছেলেমেয়েকে চাকরি করে দিয়েছি। যাদের আইটিআই, পলিটেকনিকের ট্রেনিং রয়েছে, শীঘ্রই তাদের মধ্যে থেকে আরও কয়েক লক্ষর চাকরি হবে।
একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “অনেকে বলেন, চাকরি হয় না। দেখবেন কী করে! একটা সমুদ্রের মধ্যে যদি এক মুঠো নুন ফেলেন, তাহলে কী নুনটা দেখবেন না সমুদ্র দেখবেন। চাকরি হলেও মনে রাখবেন যে জয়েন করে সে জানতে পারো, অন্যরা ততটা জানতে পারে না। মানুষ তো মহাসমুদ্র। কেউ না কেউ কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকেন। পড়াশোনা করুন, যোগ্যতা নিয়ে সারা বিশ্বকে জয় করুন। চাকরি হবেই।”