সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“বেঙ্গল অপারেশনের কথা বলছেন মন্ত্রী। আমি চ্যালেঞ্জ করছি, কালই নির্বাচন করুন। আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত।” উত্তরবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভা মঞ্চ থেকে মোদী এবং কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বাংলায় তৃণমূলকে হারানোর চ্যালেঞ্জ ছোড়ার পরে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পহেলগাঁও হামলার বদলা নিতে পাকিস্তানে ‘অপারেশন সিঁদুর’ করেছিল ভারতীয় সেনা। আর এবার বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মুখে উঠে এল ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গের’ কথা। মোদীজির নেতৃত্বে এই বিজেপি নেতারা এই ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ করবে বলেও উল্লেখ করেন সুকান্ত। আর বিজেপির রাজ্য সভাপতির এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে প্রধানমন্ত্রীর সভা ছিল। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে এই ‘অপারেশনের’ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, “মা-বোনের মাথার সিঁদুর পাকিস্তান মিটিয়েছিল। তার বদলা নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। আমার সামনে হাজার হাজার সংখ্যায় বিজেপি কর্মকর্তারা আগামী দিনে অপারেশন সিঁদুরের মতো মোদীজির সৈনিক হয়ে ‘অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ’ করে তৃণমূলকে উৎখাতকে বঙ্গোপসাগরের জলে ফেলবে। সুকান্ত এদিন মুর্শিদাবাদের অশান্তির কথাও তুলে ধরেন। তাঁর দাবি, বেছে-বেছে হিন্দুদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক কাশ্মীরে যেমন বেছে-বেছে হিন্দু নিধন করেছিল জঙ্গিরা। মুর্শিদাবাদের ঘটনা ও কাশ্মীরকে মিলিয়ে তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদে গিয়ে দেখছি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এদের দোষ মাথায় সিঁদুর আর গলায় তুলসীর মালা পড়ে। তাই এখন কাশ্মীর আর মুর্শিদাবাদ এক হয়ে গিয়েছে। ছাব্বিশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উৎখাত করতে হবে।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বেঙ্গল অপারেশনের কথা বলছে। আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কালই নির্বাচন করুন। অপারেশন বাংলা করতে চাইলে নির্বাচন করুন। সব এজেন্সি তো আপনার হাতে।”
নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। প্রত্যেক মহিলার সিঁদুরের প্রতি সম্মান রয়েছে। তাঁরা স্বামীদের থেকে সিঁদুর নেন। কিন্তু আপনি তো সবার স্বামী নন। আপনি কেন আগে আপনার স্ত্রীকে সিঁদুর দেন না?” মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য পরক্ষণেই বলেন, “আমি দুঃখিত। এটা আমার বলার কথা ছিল না। কিন্তু আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন মুখ খুলতে। মোদীজির মুখে এসব মানায় না। উনি রাজ্যে এসে বলছেন, বাংলায় অপারেশন সিঁদুর করবেন। তার মানে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে বাংলার মাটি বাংলার মহিলাদের মর্যাদা মিশিয়ে দিয়েছেন। এটা তিনি করতে পারেন? বাংলায় এসে বাংলার মানুষকে, বাংলার মাটিকে অপমান করছেন। বাংলার মহিলাদের অপমান করছেন। বড় বড় কথা বলছেন, বিজেপির রাজ্যে কী অবস্থা? গুজরাতে বসে, মধ্যপ্রদেশে পাকিস্তানকে মদত করছে, সেই ঘটনা বেরিয়েছে। তা নিয়ে কী বলবেন? বাংলায় হলে কী করতেন? আমেরিকা বললে এক মিনিটে চুপ করে যান, আর বড় বড় কথা বলেন? আমাদের এখানে নারী সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। আপনি কী করেছেন ? যারা মহিলাদের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করেছে আপনি তাদেরকে বিজয়ীর মতো ঘুরিয়েছেন। আমাদের এখানে যেমন নারীদের নিরাপত্তা আছে, সারা বিশ্বে কোথাও তেমন নেই।”
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “উনি সিঁদুর বেঁচে বেড়াচ্ছেন। মহিলাদের সম্মান করতে শিখুন। সিঁদুর খেলা আমাদের রাজ্যে হয় দুর্গাপুজোর দশমীর সময়। যতদিন আমাদের দল থাকবে ততদিন আমরা দেশের জন্য কাজ করে যাব। দেশ কারও একার নয়। দেশ আমাদের সবার।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদিকে উদ্দেশ্য করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, “বিরোধীরা যখন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে, দেশের স্বার্থে কাজ করছে, তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই ধরনের কথা (বিরোধীদের আক্রমণ) খুবই দুঃখজনক। এটা কি এইসব কথা বলার সময়!” মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন যে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিদেশে গিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, আর প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী বিরোধীদের আক্রমণ করে রাজনীতিকে কলুষিত করছেন।”
মুখ্যমন্ত্রী ১০০ দিনের কাজ এবং আবাস যোজনা নিয়েও বিজেপিকে বিঁধেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, “১০০ দিনের কাজে আপনারা কাজ করিয়ে নিয়েছেন, টাকা দেননি। আমরা সব দিলাম। আবাস যোজনার বাড়ির টাকা পর্যন্ত দেননি। কেন চার বছর ধরে বাংলার বাড়ি বন্ধ করে দিয়েছেন? গরিব মানুষের কী দোষ?” এছাড়াও, তিনি মুর্শিদাবাদ-মালদহের ঘটনার পেছনে বিজেপিকে দায়ী করে তথ্যপ্রমাণ দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন, যা রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
কলকাতা থেকে আইপিএল ম্যাচ সরানো নিয়ে এর আগে সরব হয়েছিলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। গোটা বিষয়টিকে বিজেপির কৌশল হিসাবে তুলে ধরে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। এবার এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রকে কটাক্ষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সরাসরি নাম করলেন না, কিন্তু ইডেন থেকে আইপিএল ম্যাচ সরানো যে রাজনীতির চাল, প্রধানমন্ত্রীকে তা যেন মনে করিয়ে দিলেন মমতা। রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর সফরের দিনই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “একটা মোদি স্টেডিয়াম করে দিয়েছেন সব খেলা নিয়ে চলে যাচ্ছেন সেখানে। তার কারণ? ওখানে কাটমানি নেই, ওখানে ফাইন মানি রয়েছে। ফাইন মানে সুন্দর, আমি ফাইন করার কথা বলছি না। কেন? কর্নাটকে খেলা নেই, কেরলে নেই, বাংলায় নেই, ঝাড়খণ্ডে নেই, যত খেলা হবে সব গুজরাতে? আসল অঙ্কটা কী? বলব নাকি? ভাবছেন কি আমি খোঁজ রাখি না খেলাধুলোর? সব খোঁজ রাখি।”
মোদিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেছেন, “বেশি মুখ খোলানোর চেষ্টা করবি সব খুলে দেব। আর মুখ খুললে বিদেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে যে সম্মান অর্জন করেছেন, সেই সম্মান, মনে রাখবেন দায়িত্ব শুধু বিরোধী দলের নয় তাকে রক্ষা করার। আপনি বিভাজন করবেন, আপনি বিরোধী দলকে বিভাজন করবেন, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবেন, তাকে অশান্ত করবেন, আপনি সব জাতিগতভাবে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ইশাইকে বিভাজন করবেন, ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি করবেন, তা হলে সৌদি আরবে গিয়ে শেখকে জড়িয়ে ধরেন কী করে? তখন মাথায় থাকে না হিন্দু না মুসলমান?”

নীতি আয়োগ এর বৈঠকে মমতার অনুপস্থিত থাকা নিয়ে মোদির আক্রমণের প্রেক্ষিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের প্ল্যানিং কমিশন সরিয়ে দিলেন? কেন গান্ধীজির নাম সরিয়ে দিলেন? আম্বেদকরের নাম, আজাদের নাম ভুলে গিয়েছেন। নীতি আয়োগের বৈঠকের কথা বলছেন? আমি যখন শেষবার নীতি আয়োগের বৈঠকে গিয়েছিলাম, সেদিন কেন আমার বক্তব্য মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল? সবার জন্য ১০ মিনিট করে সময় বরাদ্দ ছিল। কিন্তু আমি বলার সময় মাত্র চার মিনিটের মধ্যে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এটা রাজ্য সরকারকে অপমান নয়? এটা একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান নয়? তাহলে কেন যাব আমি সেই মিটিংয়ে? শুধু আমি নয় কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীও তো যাননি, কই সেটা তো বললেন না। আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিদেশে ঘুরে বেড়ান আর অ্যাক্টিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আর এক জনকে বানিয়ে রেখেছেন, যে কোনও কিছু মানে না। কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আপনি মানেন না।”