সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
বিহারে বিধানসভা ভোটের মুখে ভোটার তালিকার নিবিড় সংস্কারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস ও অন্যান্যদের দাখিল করা বেশ কয়েকটি রিট পিটিশন শুনতে সম্মত হল শীর্ষ আদালত। এডিআর ছাড়াও আরজেডি, যোগেন্দ্র যাদব, মনোজ ঝা এবং তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র পিটিশন দাখিল করেছেন। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এই চারটি মামলার একত্রে শুনানি হবে বৃহস্পতিবার।
মহুয়া সমাজমাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে মামলার কথা জানিয়ে লিখেছেন, ”বিহারের এসআরআই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হয়েছে। নোটিস জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার শুনানি। সত্যমেব জয়তে।”
আগামী ১০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত শুনানির সময় দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ জুন বিহারের ‘ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করে নির্বাচন কমিশন। সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে দায়ের করা এক জনস্বার্থ মামলার (PIL) আবেদনে, নির্বাচন কমিশনের ২৪ জুনের নির্দেশিকা বাতিল করার দাবি জানিয়েছে এডিআর। কমিশনের নির্দেশিকা অনুয়ারে বিহারের ভোটারদের এক বড়ো অংশকে ভোটার তালিকায় থাকার জন্য নাগরিকত্বের প্রমাণ জমা দিতে হবে। গত ৫ জুলাই শীর্ষ আদালতের কাছে করা আবেদনে এডিআর জানিয়েছে, এই পদক্ষেপ সংবিধানের ১৪, ১৯, ২১, ৩২৫ এবং ৩২৬ ধারা লঙ্ঘন করে এবং ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং ১৯৬০ সালের ভোটার নিবন্ধন বিধিমালার ২১ক ধারার বিধান লঙ্ঘন করে।
সোমবার আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী কপিল সিব্বাল শীর্ষ আদালতে বিচারপতি সুধাংশু ধূলিয়া এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে বিষয়টি পেশ করেন। এর পরেই বিচারপতিদ্বয়ের বেঞ্চ আগামী বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই আদালত বিষয়টি শুনতে রাজি হয়।
এখনও পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে এডিআর, আরজেডি সাংসদ মনোজ কুমার ঝা ও সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব, পিইউসিএল, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র প্রমুখ। এঁরা প্রত্যেকেই গত ২৪ জুন কমিশনের আনা নির্দেশিকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হতেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ২৬ জুন তিনি দাবি করেন, ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য দেওয়া ডিক্লারেশন ফর্মটি অত্যন্ত আপত্তিকর। মমতা প্রশ্ন তোলেন, “১৯৮৭ সালের আগে যারা জন্মেছে, তাদেরটা কেন গণনা করা হবে না? ডিক্লারেশনে বাবা-মায়ের বার্থ সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, সেই সময় কতজন বাবা-মায়ের বার্থ সার্টিফিকেট থাকত?
এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে মমতা বলেন, “বিহার থেকে যাচাই শুরু হচ্ছে। এটা কী হচ্ছে? বিহারে তো বিজেপির সরকার, সেখানে কিছু করবে না। বাংলাকে টার্গেট করা হচ্ছে। বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের টার্গেট করা হচ্ছে। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ। সবাইকে ক্রীতদাস পেয়েছেন? মাফ করবেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্রীতদাস নয়। প্রচারকদের দিয়ে এসব করানো হয়েছে। এতে অনেক ঘাপলা আছে, মানে স্ক্যাম আছে।”
কী এই ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’?
গত জুন মাসের ২৪ তারিখ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিহারের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের নির্দেশ জারি করা হয়। যার ভিত্তি বছর হিসেবে ঠিক করা হয়েছে ২০০৩ সালকে। কমিশনের নির্দেশিকা অনুসারে, রাজ্যের ৭.৮ কোটি ভোটারকে বিশেষ ফর্ম পূরণ করতে হবে। ২০০৩ সালের তালিকায় যাদের নাম ছিল, সেই ৪.৯৬ কোটি ভোটারকে কোনও অতিরিক্ত নথিপত্র জমা দিতে হবে না। কিন্তু ২০০৩-পরবর্তী সময়ে যাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ – ২.৯৩ কোটি মানুষকে তাদের নিজের এবং তাদের পিতামাতার জন্ম তারিখ এবং/অথবা জন্মস্থানের প্রমাণপত্র দিতে হবে।
কমিশনের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে এডিআর জানায়, ২৪শে জুনের নির্দেশিকা “ভোটার তালিকায় থাকার দায়িত্ব রাজ্যের উপর থেকে নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই বিশেষ পুনর্মূল্যায়নে আধার বা রেশন কার্ডের মতো সনাক্তকরণ নথি বাদ দেওয়া হয়েছে, যা প্রান্তিক মানুষ এবং গরিব মানুষদের ভোটদান প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।”
কমিশনের এই নির্দেশিকা প্রসঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকাঅর্জুন খাড়গে জানিয়েহেন, বিহারের ভোটাররা গণতন্ত্র এবং সংবিধানের উপর আক্রমণের জন্য গেরুয়া দলকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন। তিনি আরও বলেন, এই পদক্ষেপের ফলে প্রায় আট কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়াও বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা আগামী ৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘটের অংশ হিসাবে ইন্ডিয়া মঞ্চ রাজ্যে রাজ্যে এই বিষয়টি তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কমিশনের নির্দেশিকার বিরোধিতা করে আরজেডি-র রাজ্যসভা সাংসদ মনোজ ঝা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলির সাথে কোনও পরামর্শ ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে সিদ্ধান্ত অনুসারে, ভোটার তালিকায় আক্রমণাত্মক এবং অস্বচ্ছ সংশোধনকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য মুসলিম, দলিত এবং দরিদ্র অভিবাসী সম্প্রদায়কে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে লক্ষ্যবস্তু করে ব্যবহার করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এই ভাবনার কোনোটাই অপরিকল্পিত ভাবনা নয় বরং পরিকল্পিতভাবে এঁদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেবার প্রয়াস।