সুমনা মিশ্র। কলকাতা সারাদিন।
খাস কলকাতায় সাতসকালেই হাড়হিম করা ঘটনা। এবার উদ্ধার হল ট্রলিব্যাগ বন্দি মুণ্ডহীন দেহ। তাও আবার তা টেনে আনছিলেন দুই মহিলা। উত্তর কলকাতায় সাত সকালে এই ঘটনায় উত্তেজনা তুঙ্গে। মঙ্গলবার সকালে আহিরীটোলার কাছে, কুমোরটুলি ঘাটের ধারে দুই মহিলাকে ভারী ট্রলি ব্যাগ টানতে দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। খবর যায় উত্তর বন্দর থানায়। ট্রলিব্যাগ খুলতেই ভিতরে মেলে মুণ্ডহীন এক মহিলার মৃতদেহ। মাস্কে মুখ ঢাকা দুই মহিলাকে আটক করেছে পুলিশ। তদন্তে নেমে একের পর এক গা শিউরে ওঠা রহস্যের সন্ধান পায় পুলিশ।
প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, ধৃতদের নাম ফাল্গুনী ঘোষ ও আরতি ঘোষ। সম্পর্কে ফাল্গুনীর মা আরতি। মৃত মহিলার নাম সুমিতা ঘোষ। তিনি অসমের জোড়হাটের বাসিন্দা ও বিবাহবিচ্ছিন্না। মধ্যমগ্রামে ভাড়া থাকতেন তিনি। সম্পর্কে ফাল্গুনীর পিসি শাশুড়ি হন সুমিতা। পারিবারিক বচসার জেরে পিসি শাশুড়িকে খুন করে ধৃত ২ মহিলা। মধ্যমগ্রামের বাড়িতেই খুন করা হয় বলে জেরায় স্বীকার মা ও মেয়ের। এরপর মধ্যমগ্রাম থেকে একাধিক গাড়ি চড়ে তারা কুমারটুলি আসে। জেরায় ধৃত মা ও মেয়ে জানান, দেহ গঙ্গায় ফেলার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন তারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, ফাল্গুনি-সুমিতাদের বাড়ি মধ্যমগ্রামে। গতকাল রাতে মা-মেয়ের সঙ্গে পিসি শাশুড়ির বিবাদ হয়। তার জেরে ভারী কিছু দিয়ে পিসি শাশুড়ির মাথায় আঘাতের জেরেই মৃত্যু বলে মনে করা হচ্ছে। জেরায় মা-মেয়ে জানিয়েছেন, ট্রলিব্যাগে দেহ পুরে তাঁরা মধ্যমগ্রাম স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠেন। এরপর কুমোরটুলি ঘাটে এনে ব্যাগ সমেত দেহ গঙ্গায় ফেলার ছক ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সকাল ৭টা নাগাদ ট্যাক্সি করে গঙ্গার ঘাটে আসেন মাস্ক পরা দুই মহিলা। ভারী ব্যাগ টেনে ঘাটে আনতে দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। মহিলারা দাবি করেন, ব্যাগে পোষ্য কুকুরের মৃতদেহ রয়েছে। খবর যায় উত্তর বন্দর থানায়। পুলিশ এসে ট্রলিব্যাগ খুলতেই ভিতরে মেলে পচাগলা রক্তাক্ত দেহ। ঞযে ট্যাক্সিতে করে ট্রলিটি আনা হয়েছিল, তার চালকও পুলিশের জালে।স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুই মহিলা দাবি করেন, এর আগে তাঁরা প্রিন্সেপ ঘাট, মধ্যমগ্রাম-সহ ৩টি জায়গায় দেহ ফেলার চেষ্টা করে। প্রথমে ট্যাক্সি নিয়ে তারা যায় প্রিন্সেপ ঘাটে। কিন্তু সেখানে অনেক লোকজন, ভিড় দেখে ট্রলি ফেলার সাহস পায়নি ধৃতরা। এরপর ট্যাক্সি নিয়েই তারা নানা ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। আহিরিটোলা ঘাটে অপেক্ষাকৃত কম ভিড় দেখে সেখানে ট্যাক্সি থেকে দেহ-সহ ট্রলি নামিয়ে গঙ্গায় ফেলতে যাওয়ার পথেই বিপত্তি। ঘাটে উপস্থিত মানুষজন ওই ট্রলি থেকে গন্ধ পান, তাতেই বাড়ে সন্দেহ। তাদের জিজ্ঞাসা করে জানা যায়, কুকুরের দেহ রয়েছে ট্রলিতে। কিন্তু তা বিশ্বাস না করে পুলিশকে খবর দেন উপস্থিত লোকজন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পর্দাফাঁস হয়ে যায়।
ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ট্রেনের টিকিট। তা কাজিপাড়া থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত।
কলকাতা পুলিশের জয়েন্ট সিপি (ক্রাইম) রুপেশ কুমার জানিয়েছেন, সুমিতা ঘোষের দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। দুই মহিলাই সবটা করেছে নাকি আরও কেউ জড়িত? ধৃত দুই জনকে টানা জেরা করে জানার চেষ্টায় পুলিস।

মধ্যমগ্রামের যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেখানকার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা যায় এরা সাধারণত প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঠিকমতো মেলামেশা করতেন না। এমনকী কথাও বলতেন না এবং এই বাড়িতে বেশ কিছু অপরিচিত মানুষের আনাগোনা ছিল।এছাড়াও প্রতিবেশীরা জানায়, এরা প্রায় আনুমানিক আড়াই বছর ধরে এখানে ভাড়া আছেন। এই মা ও মেয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়েছিল প্রতিবেশীরা এবং সেটা নিয়ে একাধিকবার কাউন্সিলরকেও জানিয়েছেন তারা। কাউন্সিলর জানায় বাড়ির মালিককে ঘটনাটি জানানোর পরেও কোনওরকম সুরাহা মেলেনি।
এই ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সিপি মনোজ ভার্মা বলেন, ”মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে নর্থ পোর্ট থানায় খবর আসে। তবে মূল ঘটনা যেহেতু মধ্যমগ্রামে ঘটেছে তাই সেখানকার পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। খুনের কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। আমাদের টিম সেখানে যাবে, ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হবে।”

গোটা ঘটনায় স্থানীয়দের উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করছেন মন্ত্রী শশী পাঁজা। এলাকাটি শশীর বিধানসভা কেন্দ্র। পুলিশের হাতে ট্রলিবন্দি দেহ হস্তান্তরের আগে শশীকে ফোন করেছিলেন স্থানীয়রা। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসেন তিনি। পরে স্থানীয়দের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসাও করেন। মন্ত্রীর কথায়, “গঙ্গার ধারে অনেকেই ঘুরতে আসেন। দুজন মহিলা একটি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে গঙ্গার ধারে ইতস্ততভাবে ঘোরাফেরা করছেন দেখে ওদের কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। যেই ওরা ট্রলিটি গঙ্গায় ভাসাতে যায়, তখনই ওরা জানতে চায় কী আছে। ওই দুই মহিলা কুকুরের দেহ আছে বলতেই ওরা কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলেছিল, তাহলে কর্পোরেশনে খবর দিই!”