শৌভিক তালুকদার। কলকাতা সারাদিন।
রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া বিল আটকে রাখা নিয়ে রাজ্যপালকে এক্তিয়ার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এমনকি রাষ্ট্রপতিকেও নির্ধারিত সময়ের মধ্য়ে বিল ছেড়ে দিতে হবে বলে জানানো হয়েছে। আর সেই নিয়ে এবার দেশের শীর্ষ আদালতের তীব্র সমালোচনা করলেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়। আদালত ‘Super Parliament’ নয় বলে মন্তব্য করলেন তিনি।
আদালত রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দেয় কী করে, প্রশ্ন তুলেছেন ধনকড়। (Jagdeep Dhankhar)
রাজ্যসভার ইন্টার্নদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে এই মন্তব্য করেছেন ধনকড়। উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন তিনি। সেই সময় তাঁর সঙ্গেও সংঘাত দেখা দেয় মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের সরকারের। সম্প্রতি তামিলনাড়ুতেও একই সমস্য়া দেখা দিলে, সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যপালের ক্ষমতা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া বিল রাজ্যপাল অনির্দিষ্ট কালের জন্য ফেলে রাখতে পারেন না। রাষ্ট্রপতিকেও তিন মাসের মধ্যে বিল ছেড়ে দিতে হবে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী, তাঁদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা নেই। (Supreme Court)
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় যে তাঁর মনঃপুত হয়নি, তা পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন ধনকড়। তাঁর বক্তব্য, “আজকের এই দিন দেখার জন্য গণতন্ত্র চাইনি আমরা। সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে সময় বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। তা না হলে (বিল) আইনেপরিণত হবে। বিচারপতিরা আইন প্রণয়ন করছেন, নির্বাহী কার্য সম্পাদন করছেন। সুপার পার্লামেন্টের মতো আচরণ করছেন। তাঁদের উপর দেশের আইন কার্যকর নয় বলে কোনও দায়বদ্ধতা নেই।”
ধনকড় আরও বলেন, “সংবিধানকে রক্ষা করার, সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখার শপথ নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়। কিসের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দেওয়া হল? শুধুমাত্র সংবিধানের ১৪৫ (৩) অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করার এক্তিয়ার আছে বিচারব্যবস্থার, তাও পাঁচ অথবা তার অধিক বিচারপতির বেঞ্চই করতে পারে। দেশের সংবিধান রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালদের আইনি প্রক্রিয়া থেকে রক্ষাকবচ দিয়েছে। আইনের ঊর্ধ্বে কেন এই রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে? প্রত্যেক ভারতীয় আজ তার কারণ বুঝতে পারছেন। তাঁরা উদ্বিগ্ন। অনুচ্ছেদ ১৪২ এখন পরমাণু শক্তিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টা ব্যবহার করে চলেছে বিচারব্যবস্থা।” সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একদা আইনের পেশায় থাকলেও, অধুনা উপরাষ্ট্রপতি ধনকড় আদালতের সেই বিশেষ ক্ষমতা নিয়েই এবার সমালোচনা করলেন। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ সংশোধন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন ধনকড়।
দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি যশবন্ত বর্মার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধারের প্রসঙ্গও টেনে আনেন ধনকড়। তাঁর বক্তব্য, “১৪-১৫ মার্চ রাতে দিল্লির বিচারপতির বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটল। সাতদিন কেউ জানতেই পারেনি। আমাদের নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে। এই ঢিলেমি কি কাম্য? অন্য কেউ হলে পরিস্থিতি অন্য হতো। ২১ মার্চ সংবাদমাধ্যম থেকে সকলে জানলেন। আগে কখনও এমন হয়নি। অন্য কেউ হলে FIR দায়ের হতো। কিন্তু বিচারপতির বিরুদ্ধে FIR দায়ের করা যায় না। বিচারবিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সংবিধানে তেমন লেখা নেই।”
গত কয়েক বছরে একাধিক রাজ্যে, বিশেষ করে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যেখানে ক্ষমতায় আসীন, সেখানে বার বার রাজ্য এবং রাজ্যপালের মধ্যে সংঘাত দেখা গিয়েছে। রাজ্য বিধানসভায় পাস হওয়া বিল আটকে রাখা থেকে নির্বাচিত সরকারের পাশাপাশি সমান্তরাল সরকার চালানোর চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। সেই আবহেই তামিনাড়ুর এমকে স্ট্যালিন সরকার রাজ্যপালের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়। ১০টি বিল রাজ্যপাল আটকে রেখেছেন বলে অভিযোগ জানায় তারা। সেই নিয়ে শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, যে ১০টি বিলকে, সেগুলি রাজ্যপাল যেভাবে আটকে রেখেছেন, তা বেআইনি এবং স্বেচ্ছাচারিতা। রাজ্যপালের সেই পদক্ষেপ বাতিল করা হল। রাজ্যপালের কাছে পুনরায় যেদিন বিল পাঠানো হয়, সেই দিল থেকেই বিলগুলি পাস হয়ে গিয়েছে বলে ধরা হবে। রাজ্যপালের উদ্দেশ্য ‘সৎ’ নয় বলেও মন্তব্য করে আদালত।

পাশাপাশি, সুপ্রিম কোর্ট আরও জানায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল যদি না ছাড়েন রাষ্ট্রপতি, তাঁর তরফে যদি বিলটি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য না করা হয়, সেক্ষেত্রে আদালতে আবেদন জানাতে পারবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ‘Writ of Mandamus’ জারির জন্য আবেদন জানাতে পারবে। রাষ্ট্রপতির ভেটো ক্ষমতা নেই। হয় তিনি বিলে সমর্থন জানাবেন অথবা জানাবেন না। অর্থাৎ বিলটি নিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে কোনও ক্ষমতা নেই। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বিষয়টি মিটে যাওয়া কাম্য। বিল নিয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণে রাষ্ট্রপতিকে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। সেই নিয়েই এবার সুপ্রিন কোর্টের সমালোচনা করলেন ধনকড়।