সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
এসআইআর আতঙ্কে বাংলায় বিরামহীন মৃত্যু মিছিল। দক্ষিণ থেকে উত্তর সর্বত্র একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা প্রায় প্রতিদিন সামনে আসছে। আতঙ্ক বাড়িয়ে শুক্রবার এক দিনে পৃথক চারটি জায়গা থেকে চার জনের মৃত্যুর খবর সামনে এল। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারের দাবি, এসআইআর ঘোষণার পর থেকে ভিটে মাটি দেশ ছাড়া হওয়ার ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলেন তারা। প্রবল এই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন কেউ বা বাধ্য হয়েছেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে।
*কুলপি*
এসআইআর আতঙ্কে মৃত্যু হল শাহাবুদ্দিন পাইক(৪৫) নামে এক ব্যাক্তির। ঘটনাটি ঘটে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি বিধানসভার ঢোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের কালীচরণপুর গ্রামে।স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে ঢোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের কালীচরণপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন পাইক বেশ কয়েক দিন ধরে এস আই আর আতঙ্কে ভুগছিলেন এমনি অভিযোগ।তার চার ছেলে ও স্ত্রী কে নিয়ে সংসার ছিল।স্থানীয় একটি বেসরকারি মাদ্রাসায় পড়াতেন শাহাবুদ্দিন পাইক।
২০০৩ সালের ভোটার লিস্টে বাবা আব্দুল মজিদদের নাম থাকলেও শাহাবুদ্দিন পাইক এবং তার স্ত্রী নাম নেই।এমনকি শাহাবুদ্দিন পাইকের স্ত্রীর নথি পত্রেও কিছু গরমিল ছিল।বিশেষ করে আঁধার কার্ডে নামের ভুল ছিল শাহাবুদ্দিন পাইকের স্ত্রীর এমনি অভিযোগ।ফলে ভোটার লিস্টে শাহাবুদ্দিন পাইকের নাম না থাকায় এবং স্ত্রীর আঁধার কার্ডে নাম ভুল থাকায় আতঙ্কে কিছু দিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন শাহাবুদ্দিন পাইক অভিযোগ।গত শনিবার প্রায় সকাল ৯ টা নাগাদ শাহাবুদ্দিন পাইকের স্টোক হলে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে প্রথমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায়।সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে হলে চিকিৎসকরা তাকে ডায়মন্ডহারবার মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে।সেখানেই তার চিকিৎসা চলছিল।বৃহস্পতিবার রাতে তাকে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করে।আর এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই কুলপি কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক যোগরঞ্জন হালদার এবং মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ বাপী হালদার মৃতের বাড়িতে যায়।পাশাপাশি তারা মৃতের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানায় এবং সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দেন।এ বিষয়ে সাংসদ বাপী হালদার এবং বিধায়ক যোগরঞ্জন হালদার জানান রাজ্য জুড়ে মানুষ এস আই আর নিয়ে বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত।ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মৃত্যুর খবর আছে।আর এর জন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায় কেন্দ্র সরকার এবং নির্বাচন কমিশন।এদিকে এই ঘটনায় এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।
*সাঁইথিয়া*
ইলামবাজারের পর এসআইআর আতঙ্কে বীরভূমের সাঁইথিয়ার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিমান প্রামাণিকের মৃত্যু হোলো । পরিবারের দাবি এস আই আর ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আতঙ্কে ভুগছিলেন বিমান প্রামানিক। ২০০২ এর ভোটার তালিকায় বিমান বাবুর পদবি বদল হয়ে যায়। সেই তালিকায় তার নাম হয়ে যায় বিমান পাল। মৃত ব্যক্তির ভাই বিধান প্রামানিক জানিয়েছেন, ২০০২ সালে যখন এস আই আর হয় তখন দাদার নামের পদবী প্রামানিকের বদলে পাল হয়ে যায়। এতদিন কোন চিন্তায় ছিল না দাদা। কিন্তু এই বছর নতুন করে এস আই আর ঘোষণা হওয়ায় মারাত্মক চিন্তায় ছিল দাদা। হামেশাই বলতো আমার নামের পদবী বদল হয়ে গেছে হয়তো আমাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেবে। রাতে ঘুমাতে পারছিল না। মৃত্যুর আগে দাদা বলতো আসামে অনেক হিন্দুকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে, আমাকেও মনে হয় পাঠিয়ে দেবে। পরিবারের সঙ্গে দেখা হবে না। এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় থাকবো এই চিন্তা শেষ করে দিচ্ছে। নতুন করে ফর্মে নাম তোলার বিষয়টি সামনে আসতেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে দাদা। বারবার বলতে থাকে কোনভাবেই বোধহয় আর সাইথিয়াতে থাকা হবে না। বুধবার রাতে হঠাৎ করেই প্রচন্ড বুকে যন্ত্রণা অনুভব করে, এরপর আমরা তড়িঘড়ি সাঁইথিয়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই মৃত্যু হয় দাদার। বিধান প্রামাণিক আরও দাবি করেন, আমার দাদা অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিলেন। সারাদিন পাড়ায় মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সেই মানুষ কত পাঁচ দিন ধরে হঠাৎ করে একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। সারাদিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকতেন। দাদা কি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যদি সমস্যা হয় সকলের হবে, পরিবারের কেউ তোমায় একা ছেড়ে দেবে না। তাও দাদা আতঙ্কে ছিলেন। বীরভূমের জেলাশাসক ধবল জৈন জানিয়েছেন, বিষয়টি আমরা দেখছি। প্রশাসনিক স্তর থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সাঁইথিয়া বিধানসভার বিধায়ক নীলাবতি সাহা বলেন খুবই মর্মান্তিক ঘটনা।
*শেওড়াফুলি*
কুলপি, সাঁইথিয়ার পর হুগলির শেওড়াফুলি। এস আই আর আতঙ্কে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফের মৃত্যু। নিহত মহিলা স্থানীয় যৌনপল্লীতে থাকতেন। স্থানীয় বাসিন্দা সোমনাথ মাঝি বলেন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ওই এলাকায় তিনি বসবাস করছেন। এস আই আর চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আতঙ্কে ভুগছিলেন, ২০২৫ সালে ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় তার নাম ছিল না এটাই ছিল যৌন কর্মীর আতঙ্কের মূল বিষয়। সকালের দিকে যৌনকর্মীর ঘরে তার সাড়া না পেয়ে পাশের ঘরের পরশিরা ডাকাডাকি করেন ভেজানো দরজা, ধাক্কা মারতেই খুলে যায় এবং দেখেন তিনি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছেন। এরপরই শেওড়াফুলি ফাঁড়ি তে খবর দেওয়া হয় ঘটনাস্থলে চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের অন্তর্গত শ্রীরামপুর থানা ও শেওড়াফুলি ফাঁড়ির পুলিশ আধিকারিকরা এসে দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শ্রীরামপুর ওয়ালস হসপিটালে পাঠান। এই ঘটনায় এলাকায় যথেষ্ট চাঞ্চল্য ছড়ায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন চাঁপদানি বিধানসভার বিধায়ক তথা শ্রীরামপুর হুগলি সংগঠনিক জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অরিন্দম গুইন, বৈদ্যবাটি পৌরসভার পৌর প্রধান পিন্টু মাহাতো ও ওই এলাকার পৌর প্রতিনিধি বিশ্বজিৎ সিং।

এই ঘটনা সম্পর্কে বিধায়ক তথা সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি বলেন এই এসআইয়ে আতঙ্কে মৃত্যু মিছিল বেড়েই চলেছে এটা কোনদিনই মেনে নেওয়া যায় না আর মমতা ব্যানার্জি বঙ্গবাসীকে অস্বস্ত করেছেন কোন বৈধ ভোটারের নাম বাদ যাবে না আর যদি যায় তাহলে তৃণমূলের তরফ থেকে বিশাল আন্দোলনে নামা হবে। এই এসআইআর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ওই এলাকার আরো অনেক যৌনকর্মীর মধ্যে তারা যথেষ্টই আতঙ্কের মধ্যে আছে।