শফিকুল আলম। কলকাতা সারাদিন। ঢাকা।
২০২৪ সালের জুলাই আগস্ট মাসে বাংলাদেশ কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান দমন করতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার নির্দেশ সরাসরি দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পরে শেখ হাসিনাকে এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনালো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার আজ রায় ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দুটি অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শুরুতে রায়ের অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার। ট্রাইব্যুনালের বাকি দুই সদস্য বিচারপতি মোহাম্মদ শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মোহাম্মদ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীও রায়ের বিভিন্ন অংশ পড়ে শোনান। আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষণা করা ৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে ছয়টি অংশ রয়েছে। রায় ঘোষণা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির অপরাধ প্রমাণিত। দুটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হওয়ায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এর আগে, ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের বিবরণ দেওয়া হয়। বিচারকাজ চলার সময় অডিয়ো, ভিডিয়োসহ যেসব তথ্য প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়। ঘটনার শিকার ও সাক্ষীরা কী বলেছে তার বর্ণনা দেওয়া হয়। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে, সেগুলোর ভিডিও ও তথ্যপ্রমাণের বিবরণ দেওয়া হয়। আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টের বিভিন্ন অংশ পড়ে শোনানো হয়। গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন জনের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোনে কথোপকথনগুলো শোনানো হয়। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা কাণ্ডে শেখ হাসিনা-সহ তিনজনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ছিল। সেই আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বারবার বদলাতে বাধ্য করা হয়েছিল চিকিৎসককে, রায়দান প্রক্রিয়ায় সেকথা বললেন বিচারপতি। ময়না তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসককে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও জানাল ট্রাইব্যুনাল। রায়ের শেষ অংশ থেকে বিচারপতি পড়ে শোনান, ছাত্রদের কথা শোনার পরিবর্তে আন্দোলনকে অবহেলা করেছেন হাসিনা। আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকার বলে অপমান করেছেন।
হাসিনার তৈরি ট্রাইব্যুনালের বিচার
শেখ হাসিনাকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, যে ট্রাইব্যুনাল একসময় গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা-ই! যে ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছিল বাচ্চু রাজাকারকে। আজ সেই ট্রাইব্যুনালের রায়েই দোষী সাব্যস্ত শেখ হাসিনা! একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের মার্চে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। পরবর্তীকালে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের পরে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে বাংলাদেশের বর্তমান উপদেষ্টা সরকার। পুনর্গঠনের আগে ১৫ বছরের বেশি সময়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত মোট ৫৭ মামলার রায় দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যার মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ৬ জনের। তাঁদের মধ্যে ৫ জন জামাত-ই -ইসলামির শীর্ষস্থানীয় নেতা, আর একজন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা।
৩ আসামীর কে কোথায়
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার অন্য দুই আসামী হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিন আসামীর মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান পলাতক।
বাংলাদেশ জুড়ে বিজয় মিছিল
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার খবর সম্প্রচারিত হওয়ার পরেই ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজয় মিছিল বের করে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে মিছিল বের করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ধানমন্ডিতে মুজিবের বাড়ি ভাঙার চেষ্টা
রায় ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে গিয়েছে দফায় দফায় অশান্তি। অশান্তির আবহ সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে মজুত রাখা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। তার পরেও রাজধানীর ধানমন্ডিতে ৩২ নম্বর সড়কে দুটি এক্সক্যাভেটর নিয়ে বিক্ষোভকারীদের হামলা করতে দেখা গিয়েছে। তাদের যদিও আটকে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। কিন্তু তার পরেও বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গিয়ে দফায় দফায় আক্রমণ হানার চেষ্টা করে চলেছে। লক্ষ্য শেখ মুজিবের বাসস্থান ভেঙে ফেলা।
শান্ত থাকার আবেদন উপদেষ্টা সরকারের
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণার পরেই দেশজুড়ে যে বিক্ষিপ্ত অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার সামাল দিতে ইতিমধ্যেই উপদেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়ে বিবৃতি জারি করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড একটি ঐতিহাসিক রায়। এই মুহূর্তে এই রায়ের তাৎপর্যও বেশ গভীর। তা উপলব্ধি করে অন্তর্বর্তী সরকার সর্বস্তরের জনগণকে শান্ত, সংযত ও দায়িত্বশীল থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।

কি কি সাজা ঘোষণা
হাসিনাকে তিনটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করল আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল। এক, উস্কানি দেওয়া। দুই, হত্যার নির্দেশ এবং তিন, দমনপীড়ন আটকানোর ক্ষেত্রে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা।
শেখ হাসিনার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আদালতকক্ষ থেকে বেরিয়ে সরকারপক্ষের আইনজীবী জানান, পলাতক হওয়ায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন না হাসিনা।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল।
অপর অভিযুক্ত প্রাক্তন পুলিশকর্তা আল-মামুন রাজসাক্ষী হওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন করে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হল।