সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল ধর্ষণ এবং যৌন নিগ্রহ বিরোধী অপরাজিতা বিল। বাংলায় বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হওয়ার পরে এই প্রথম সরকার পক্ষের আনা কোন বিলে সহমত পোষণ করে ভোটাভুটি ছাড়াই বিল পাস করতে দিল। পাস হলো অপরাজিতা নারী ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল ২০২৪। তবে বিল পাশের ক্ষেত্রে সম্মতি জানালেও এ দিন বিরোধী দলের হয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলেন আমরা এই বিল সমর্থন করছি। কোনও বিরোধিতা নেই, ভোটাভুটি হবে না। কিন্তু অপরাজিতা বিল তাড়াহুড়ো করে আনা হল কেন? এই প্রশ্নও তুললেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। একই সঙ্গে বললেন, আমরা রেজাল্ট দেখতে চাই। অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে এই বিল।
আর জি কর আবহে রাজ্যে ধর্ষণের মামলার আরও দ্রুত বিচার এবং অপরাধীর কঠিন সাজার বন্দোবস্তের জন্য নতুন সংশোধনী বিল আনার ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। সেইমতো মঙ্গলবার বিধানসভায় ‘অপরাজিতা মহিলা এবং শিশু (পশ্চিমবঙ্গ অপরাধ আইন সংশোধনী) বিল ২০২৪’ পেশ করেন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। শাসক ও বিরোধীদের দীর্ঘ বচসার পর পাশ হয়ে যায় সেই বিল। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আনা নতুন সংশোধনী বিলে রয়েছে, ধর্ষণের সাজা জরিমানা-সহ আমৃত্যু সাজা। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের সাজাও। উল্লেখ্য, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ ধারায় ধর্ষণের সাজা জরিমানা-সহ অন্তত ১০ বছর কারাদণ্ড, যা যাবজ্জীবনও হতে পারে।
নয়া সংশোধনী বিলে রয়েছে, জরিমানার সেই টাকায় নির্যাতিতার চিকিৎসা, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ আদালতের দেওয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেই জরিমানার টাকা দিতে হবে। ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ২০২৩-এর ৪৬১ ধারায় উল্লেখ করা রয়েছে এমনটাই।
‘অপরাজিতা মহিলা এবং শিশু (পশ্চিমবঙ্গ অপরাধ আইন সংশোধনী) বিল ২০২৪’ -এ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৫ নং ধারা মুছে ফেলার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ১২৪ ধারাতেও বদল আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় নতুন ধারা আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিলে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ধারা ৪৬ ৩এ উপধারায় বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় ওই বিশেষ আদালত তৈরি করতে হবে। কলকাতা হাইকোর্টের সম্মতি নিয়ে ধর্ষণের বিচার করবেন রাজ্যের দায়রা বিচারক বা অতিরিক্ত দায়রা বিচারক। সরকার নির্যাতিতার হয়ে মামলা লড়ার সাত বছর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষ কৌঁসুলি (স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর) নিয়োগ করবে।
এছাড়া ৪৬ ধারার ৩বি উপধারায় জেলা স্তরে ‘বিশেষ টাস্ক ফোর্স’ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সংশোধনী বিলে। সরকারের গঠন করা সেই বাহিনীর নাম হবে ‘অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স’। যার প্রধান হবেন ডেপুটি পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক। বিলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ধর্ষণের মামলার তদন্ত করবেন মহিলা অফিসারেরা। তদন্তে ইচ্ছাকৃত ভাবে দেরি করাতে চাইলে তাঁরও শাস্তি জরিমানা পাঁচ হাজার টাকা সহ ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড পর্যন্ত হবে।
পাশাপাশি, নয়া সংশোধনী বিলে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ২০২৩-এর ১৯৩ ধারা সংশোধনেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, থানার ওসিকে এফআইআর দায়েরের ২১ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। তার মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে। তবে তার বেশি নয়। ওসি না পারলে ত্রে এসপি পদমর্যাদার অফিসারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত ১৫ দিনের সময় দেওয়া হবে তদন্তের জন্য। বিলে আরও প্রস্তাব আনা হয়েছে, চার্জশিট জমা দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিশেষ আদালতে শেষ করতে হবে বিচার।
কীভাবে এই আইন কাজ করবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই নতুন বিলের তাৎপর্য তিনটি-বর্ধিত শাস্তি, দ্রুত শাস্তি ও ন্যায় বিচার। সকল যৌন হিংসায় শাস্তি হবে কঠোর। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ১০-২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা করছি যাবজ্জবীন ও মৃত্যুদণ্ড। নির্যাতিতা কোমায় চলে গেলে প্রাণদণ্ড দেওয়ার কথা বলেছি। অ্যাসিড আক্রমণের ক্ষেত্রে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ১০ বছরের কারাদণ্ড রয়েছে। আমরা করেছি আমৃত্যু কারাদণ্ড। প্রধানমন্ত্রী নারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাই তাঁর পদত্যাগের দাবি করছি। নারী শক্তির জয় হোক। অপরাজিতারা বিচার পাক। আরজি করের দোষীদের ফাঁসি হোক এটা আমরা চাই।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই বিলের সমর্থন করলেও সাফ জানান, আগে রেজাল্ট দেখতে চাই। সেই সঙ্গে শুভেন্দু এবং বিজেপি বিধায়করা সমস্বরে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন।
বিল নিয়ে বিরোধী দলনেতার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা তীব্র কটাক্ষ করেন বিজেপিকে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে একের পর এক ধর্ষণ-যৌন নিগ্রহের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বিজেপিকে আক্রমণ করেন মমতা। বলেন, আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ চাই। তার পরে বাকি কথা। গুজরাট এবং উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কথা বলছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখনই বিধানসভায় হই-হট্টগোল শুরু হয়। মমতার বক্তৃতা চলাকালীনই তাঁর পদত্যাগের দাবি তোলে বিরোধীরা।
শুভেন্দুর প্রশ্নের উত্তরে মমতা বলেন, ‘কামদুনিতে ৩ সপ্তাহে চার্জশিট হয়েছিল। আপনারা বলেছেন ট্রেনে ধর্ষণ হয়েছে। ট্রেনটা কি আমাদের? ট্রেনের ভিতরের সুরক্ষার দায়িত্ব আরপিএফের। সেটা তাদের ব্যর্থতা।’ বিরোধী দলনেতা কিছু খবরের কাগজের প্রিন্ট আউট নিয়ে রাজ্য সরকারকে প্রশ্ন করেছিলেন। তার উত্তরে মমতা বলেন, ‘খবরের কাগজ তৈরি করাও হতে পারে। ওগুলো ফেক নিউজ। আর আপনারা এই সব বলছেন, উন্নাওয়ের কথা বলবেন না। হাথরসের ঘটনায় বিচার পায়নি কেউ। এই গুলো ফলিয়ে বলার কথা নয়। ওই সমস্ত ঘটনা লজ্জার। যে বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, যে বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তাকে ফুল মালা দিয়ে সংবর্ধনা! ধর্ষণে উসকানি নয়?’
অপরাজিতা বিল প্রসঙ্গে মমতা বললেন, ‘‘এটা একটা ইতিহাস! প্রধানমন্ত্রী পারেননি। আমরা পারলাম। প্রধানমন্ত্রী দেশের লজ্জা! উনি মেয়েদের রক্ষা করতে পারেননি। সব রাজ্য এটা আগামী দিন মনে করবে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি। বিজেপির মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করছি। রাজ্যে যে মুখ্যমন্ত্রীরা আছেন তাঁদের পদত্যাগ দাবি করছি। বিরোধী দলনেতা গুলি চালানোর কথা বলেছেন, তাঁরও পদত্যাগ দাবি করছি। আরজি করের দোষীদের ফাঁসি হোক, এটা আমরা চাই।’’
বিধানসভায় মমতা বলেন, “যে মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁর জন্য শোকজ্ঞাপন করছি। গোটা দেশে যাঁরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁদের অত্যাচারের করুণ কাহিনী কিন্তু আপনাদের (বিরোধী) মুখে শুনলাম না। ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট, নৃশংস এবং নক্ক্যারজনক ঘটনার ক্ষেত্রে অত্যবন্ত দ্রুত পুলিশি অনুসন্ধান এবং বিচারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে দোষীদেরকঠোর আশস্তি দেওয়ার কথা বলছি আমরা। যে কোনও শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই নিঃশর্ত ভাবে এই বিলকে সমর্থন করবেন আশা রাখি। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ধর্ষণ। যে সমাজে মেয়েরা ভাল থাকে না। সেই সমাজ ভাল থাকতে পারে না। আমি মনে করি, পরিবারের কাউকে হারিয়েছি।”
আর জি করের ঘটনা নিয়ে আজ মমতা বলেন, “মেয়েটি মারা গিয়েছে ৯ অগাস্ট। মৃতদেহ দাহ হয় রাত ২টো-আড়াইটে নাগাদ, অর্থাৎ ১০ তারিখ। ১২ তারিখে আমি নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়েছিলাম। যেদিন মারা যান, তাঁর বাবা-মার সঙ্গে কথা বলি। সিপি-ই ফোনে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম, তার আগে তদন্তকারীকে দিয়ে অডিও-ভিডিও, সিসিটিভি ফুটেজ পাঠানো হয়েছিল বাবা-মায়ের কাছে, যাতে বাইরে প্রচার না করে সবটা জানতে পারেন তাঁরা। আমি যখন পরিবারের সঙ্গে কথা বলি, পরিষ্কার বলে এসেছিলাম, আজ সোমবার, আমাকে রবিবার পর্যন্ত সময় দিন। তদন্ত করে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের গ্রেফতার করতে না পারলে., সিবিআই-এর হাতে মামলা তুলে দেব। তাঁরা বলেছিলেন ঠিক আছে। ১২ ঘণ্টার সময় নিয়েছিল পুলিশ মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে। টিম গঠন করা হয়েছিল, সব খতিয়ে দেখার জব্য ফাস্টট্র্যাক কোর্টে ফাঁসির আবেদন জানাতে পুলিশকে বলেছিলাম। কিন্তু মঙ্গলবারই আদালতের অর্ডারে সিবিআই হয়ে যায়। আমরা বলছি, সিবিআই-এর থেকে বিচার চাই। আমরা প্রথম থেকেই ফাঁসি চেয়ে আসছি।”