এপারে ভারতের নদীয়া জেলা। সীমানা ওপারে বাংলাদেশের যশোহর জেলার মহেশপুর গ্রাম । নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের পাবা খালি গ্রাম। মাঝখানের কাঁটাতারের বেড়া দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করেছে।
রায়চৌধুরী দের বাড়ি দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল মহেশপুর গ্রামে । যদিও পুজো শুরুর আগে অবধি মহেশপুরে জমিদাররা রায় চৌধুরী উপাধি পাননি । মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর মহেশপুরের জমিদারদের আনুগত্যে খুশি হয়ে তাদের রায় চৌধুরী উপাধি দিয়েছিলেন ।
রায়চৌধুরী উপাধি লাভের পর মহেশপুরের জমিদাররা ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন । উপাধি লাভের আনন্দ পূজার মধ্যে ভাগ করে নিতে তৎকালীন জমিদার দুর্গা পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন ।
সেই শুরু, তিনদিন ধরে জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজো তারপর ওই তিনদিন কব্জি ডুবিয়ে পেট পুজো করেছিলেন প্রজারা। মহেশপুরের সেই জমিদার নেই । দেশভাগের পর রায় চৌধুরীরা মহেশপুরে থাকার পরিবেশ নেই মনে করে বিনিময়ের মাধ্যমে চলে আসেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জের পাবাখালি গ্রামে ।
রায়চৌধুরী পরিবারের গৃহকর্তা শিবপ্রসাদ রায় চৌধুরী ওরফে পাঁচু গোপাল রায় চৌধুরী তিনি তার সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে বিনিময়ের মাধ্যমে মতুল্লা দারোগার বাড়ি ও জমি গ্রহণ করেন । ব মতুল্য দারোগা ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ । তার বাড়িতে এসে ঠাঁই । অন্য ধর্মীয় বাড়িতে আশ্রয়ের ফলে কিছুটা সমস্যায় পড়লেও পুজো বন্ধ হয়নি।
মতুল্য দারোগার বাড়ির উঠোনে চার চালা তৈরী করেই দ্বিভূজা দুর্গাপূজার সূচনা হয় ১৯৪৯ সালে । এখনো নিষ্ঠা সহকারে দুর্গাপূজা হচ্ছে, রায়চৌধুরী পরিবারের সেই চার চালাই। নিজেদের পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ১৯৯৮ সালে দীপ্তি প্রসাদ রায়চৌধুরী বন্দুক নেন । বন্দুক নেওয়ার পর থেকেই সন্ধিপূজোর সময় শূন্যে গুলি ছোড়া হয় । দশমীতে দেবীকে পান্তাভোগ দেওয়া হয় । আর তামাক ভোগ পান শিব ঠাকুর কে।
রায় চৌধুরীদের ৩৪ তম বংশধর পিনাকী রায় চৌধুরী এখন পুজো পরিচালনার মূল দায়িত্বে । তিনি বলেন দেশভাগের পর রায় চৌধুরী পরিবার মহেশপুর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে পাবাখালি গ্রামে চলে আসে ১৯৪৯ সালে । সেই থেকেই পাবাখালী গ্রামে দ্বিভুজা দুর্গাপূজার শুরু । ১৯৪৯ সালে পাবাখালীতে আসার পর দ্বি ভুজা দুর্গাপূজা শুরু হয় সেই হিসেব অনুযায়ী এবছর দ্বি ভুজা দুর্গাপূজার বয়স ৭৫ বছরে পড়ল । যদিও ওপার বাংলা এপার বাংলা মিলিয়ে পূজোর বয়স অনেকটাই বেশি ।
রায় চৌধুরী পরিবারে দ্বি ভুজা নামে পুজিত হন দশভুজা । সামনে থেকে দেখলে দেবীকে দ্বিভুজা মনে হবে , আসলে কিন্তু দেবী দশভুজা । বাকি আটটি হাত ঢাকা থেকে চুলের আড়ালে, আঙ্গুলের মত । দেবীর ডান হাতে ত্রিশূল আর বাঁ হাতে সাপের লেজ । দেবী প্রতিমার মাথার উপর চাল চিত্রের বদলে তৃতীয়ার চাঁদের মত চালি । দ্বিভুজা দুর্গা পুজো পদ্ধতি ও ভোগে নানা বৈচিত্র রয়েছে । ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন চারবার করে ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে । সকালে পাঁচ রকম ভাজা , পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে দেওয়া হয় খিচুড়ি ভোগ ।দুপুরে মাসকলাইয়ের ডাল, বিভিন্ন রকম তরকারি দিয়ে দেওয়া হয় অন্নভোগ । বিকেলে দেওয়া হয় পায়েসভোগ । সন্ধ্যা আরতির পরে লুচি, সন্দেশ, মোয়া, নারু দিয়ে দেওয়া হয় ভোগ । দশমীতে দেবীকে দেওয়া হয় পান্তা ভোগ ।
এই পারিবারিক পুজোর বেশ কিছু রীতি আছে । যেমন পয়লা বৈশাখে ভগবতী যাত্রার দিন প্রতিমার পাঠ পুজো করা হয়ে থাকে । রথের দিন দেবী প্রতিমার নির্মাণ কাজ শুরু হয় । ষষ্ঠীতে দেবীকে বোধন করে হোমের আগুন জ্বালানো হয় । প্রতিদিনই হোম হয়ে থাকে । দশমী পূজার শেষে হোমের আগুন নেভানো হয় । চন্ডী মন্ডপে প্রজ্বলিত এক মোমবাতির শিকার সংকেত মেনে অষ্টমীর সন্ধি পূজা হয়। ।
পুজোর চার দিন চণ্ডীপাঠ হয়ে থাকে । দশমীর দিনে যাত্রা মঙ্গল রায় চৌধুরীদের দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য । এদিন মহাদেবকে তামাক ভোগ দেওয়া হয় । দশমিতে দেবীর প্রতিমাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে শিবনি বাসের চূর্ণী নদীর জলে নিরঞ্জন করা হয়।