শৌনক মন্ডল। কলকাতা সারাদিন।
বাংলার ছয় বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে নয়া রেকর্ড গড়লো সিপিএম। এই প্রথম কোন নির্বাচনে বা উপনির্বাচনে ১০০ শতাংশ আসনেই সিপিএম তথা বামফ্রন্টের প্রার্থীরা জামানত খুইয়ে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হলো।
তবে সিপিএমের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই দেশের শাসকদল তথা বাংলার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিজেপি। এবারের উপনির্বাচনের আগে শুভেন্দু অধিকারী রীতিমতো নাওয়া খাওয়া ভুলে যে কেন্দ্রগুলিতে ভোটের প্রচারে গিয়েছেন সেই সমস্ত আসন গুলিতে রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে হাঁটতে হয়েছে বিজেপিকে।
যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর বিধানসভা, রয়েছে উত্তরবঙ্গের মাদারিহাট এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটি বিধানসভা।
উত্তরবঙ্গের সিতাই এবং দক্ষিণবঙ্গের হাড়োয়া— দুই বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিল, বিরোধীরা নেই। বাম-বিজেপি কেউই নেই। দু’টি আসনেই কোনও বিরোধী প্রার্থী তাঁদের জামানত রাখতে পারলেন না। দু’টি আসনেই এক লক্ষেরও বেশি ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের বিধানসভাভিত্তিক ফলাফলের সঙ্গে উপনির্বাচনের ফলাফল পাশাপাশি রাখলে দেখা যাচ্ছে, ক্রমশ আরও কমছে বিজেপির জনসমর্থন।
হাড়োয়ায় তৃণমূলের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে এসেছেন আইএসএফের পিয়ারুল ইসলাম। তবে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের রবিউল ইসলামের ভোটের ব্যবধান ১ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি। আইএসএফ এই একটি আসনেই লড়ে দ্বিতীয় হয়েছে। যদিও জামানত রক্ষা করতে পারেনি নওশাদ সিদ্দিকির দল। বিবৃতি জারি করে আইএসএফ এই নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলে কটাক্ষ করেছে।
এই উপনির্বাচনে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল-বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের সব কটি কেন্দ্রেই জামানত বাজেযাপ্ত হয়েছে। সুতরাং বাংলার মানুষ এই দুটি দলকে আবার রাজনৈতিক প্রত্যাখ্যান করল বলে মনে করা হচ্ছে।
একক ভাবে লড়েও ভোটের ময়দানে ‘দৈন্য’ কাটল না। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার উপনির্বাচনে সর্বত্রই জামানত জব্দ হয়েছে বাম ও কংগ্রেসের। এ বারের উপনির্বাচনে প্রার্থীঘোষণার আগে বেশ কিছুকাল ধরে বামদের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হবে কিনা, তা নিয়ে ধন্দ ছিল। শেষ পর্যন্ত ঘোষিত বা অঘোষিত কোনও প্রকার জোট হয়নি বাম-কংগ্রেসের।
ভোটের যা ফলাফল, তাতে রাজ্যে কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা মানছেন প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরী। তবে ভোট ময়দানে দলের ‘দৈন্যে’র জন্য তৃণমূল এবং বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “কংগ্রেসের সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই দুর্বল। এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তার উপর বিজেপি এবং তৃণমূল মিলে পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতি কায়েম করেছে। এই মেরুকরণের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত আমাদের জন্য লড়াই কঠিন! এতে কোনও সন্দেহ নেই।”
পক্ষান্তরে, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, নির্বাচনী রাজনীতিতে ভোট, সংখ্যা, শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলেও এগুলিই সব নয়। সংগঠনে দুর্বলতার কথাও মানছেন তিনি। তবে সেলিমের কথায়, “আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের পুনর্জাগরণ ঘটাতে গেলে বামপন্থার পুনর্জাগরণ অবশ্যম্ভাবী।”
কিন্তু বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের অবস্থা আজ এমন হল যে, প্রত্যেক রাউন্ড গণনা শেষে তথ্য উঠে এল-নোটার সঙ্গে লড়াই হল বাম-কংগ্রেস প্রার্থীর। এমনটা বহু জায়গায় হয়েছে। তাই এটাকে রাজনৈতিক প্রত্যাখ্যান বলা হচ্ছে। মাদারিহাটে নোটায় পড়েছে ২ হাজার ৮৫৬ ভোট। আরএসপি এবং কংগ্রেস যথাক্রমে পেয়েছে ৩ হাজার ৪১২ এবং ৩ হাজার ০২৩ ভোট। যা এখন চর্চার বিষয়।
অন্যদিকে তালড্যাংরায় ৩৪ হাজার ৮২ ভোটে জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ফাল্গুনী সিংহবাবু। আর নৈহাটিতে ৪৮ হাজার ৮৭৯ ভোটে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সনৎ দে। হাড়োয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী রবিউল ইসলাম ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৩৮৮ ভোটে জয়ী হয়েছেন। মেদিনীপুরে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুজয় হাজরা ৩৩ হাজার ১৯০ ভোটে জয়ী হয়েছেন। সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ১৫৬ ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সঙ্গীতা রায়। সিতাইয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের থেকে বেশি ভোট পেয়েছে কংগ্রেস। আর সিতাই কেন্দ্রে ফরওয়ার্ড ব্লক পেয়েছে ৩,৩১৯ ভোট। নোটায় পড়েছে ১,৩১৭ ভোট।
রাজনীতিতে ভোট সংখ্যার চেয়ে শতাংশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেই পরিসংখ্যানই নির্দিষ্ট এলাকায় সংশ্লিষ্ট দলের গণভিত্তির ‘সূচক’। সিতাইয়ে বিজেপির ভোট শতাংশে ধস নেমেছে। ২০২১ সালে কোচবিহারের এই কেন্দ্রে বিজেপি পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মধ্যে উপনির্বাচনে তাদের ভোট কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু সেই ভোট কোনও বিরোধী পরিসরে যায়নি। বরং গিয়ে পড়েছে শাসক তৃণমূলের বাক্সে। তালড্যাংরা, মেদিনীপুর, নৈহাটিতেও ব্যবধান বৃদ্ধি করেছে তৃণমূল। আবার হাতের বাইরে থাকা মাদারিহাট আসনটিও প্রথম বার জিতেছে তৃণমূল।
যদিও এই হারকে ‘গুরুত্ব’ দিতে চায়নি বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ”এটা কোনও ভোটই নয়। ২০২৬ সালে এই সব জায়গাতেই বিজেপি জিতবে। রেজাল্ট পুরো উল্টে যাবে।” পাল্টা কটাক্ষ করে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ”বিজেপির আইটি সেলের উচিত শুভেন্দুকে ওঁর পুরনো কথাগুলো কোলাজ করে শোনানো। তা হলে যদি বাজে বকা বন্ধ হয়!”