কলকাতার হাজরা মোড়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘটে গেল এক রোমহর্ষক ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির অদূরে ব্যাগে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল এক প্রৌঢ় শিক্ষককে! তাঁর আচরণ সন্দেহজনক মনে হতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে নিরাপত্তা বাহিনী। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় কালীঘাট থানায়।
পরবর্তীতে জানা যায়, ওই ব্যক্তি হলেন দেবাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় (৫১), সল্টলেকের বাসিন্দা এবং কলকাতার একটি নামী স্কুলের শিক্ষক। তাঁর ব্যাগে ছিল একটি এয়ারগান, যার বৈধ নথিও তিনি পুলিশকে দেখিয়েছেন।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ার অদূরে ব্যাগে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরার খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় চাঞ্চল্যের পারদ চড়তে থাকে। হাজরা মোড় থেকে কালীঘাট পর্যন্ত মুহূর্তে গুজবের ঝড় ওঠে।
পুলিশি তৎপরতায় আটক, থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা
লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেল নাগাদ কালীঘাট থানার টহলরত পুলিশকর্মীরা প্রৌঢ়কে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখেন। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা অফিসাররা বিষয়টি বুঝে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাজরা মোড়ে আটক করে।
তদন্তে নামেন কালীঘাট থানার অফিসাররা। দেবাঞ্জনবাবুর কাছ থেকে উদ্ধার হয় একটি এয়ারগান এবং কয়েকটি পেলের গুলি। তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে টানা ছয় ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
রাতে নথিপত্র খতিয়ে দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়, অস্ত্রটি বৈধ এবং এটি প্রাণঘাতী নয়। সন্দেহজনক কিছু না মেলায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
কে এই দেবাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়?
দেবাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পেশায় একজন শিক্ষক, পাশাপাশি তিনি একটি ল ফার্মও পরিচালনা করেন। পুলিশের কাছে তিনি জানিয়েছেন, তিনি শ্রীরামপুর রাইফেল ক্লাবের সদস্য এবং শুটিং ট্রেনিং নেন নিয়মিত।
নিজের বক্তব্যে দেবাঞ্জনবাবু বলেন,
> “আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আমার দুটি আর্জি ছিল। গাড়ি থেকে নামার আগে নিজেই নিরাপত্তারক্ষীদের অস্ত্র দেখিয়েছিলাম। ওরা ভেবেছিল এটা আসল পিস্তল, তাই আতঙ্কিত হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন,
> “আমি কোনও বেআইনি কাজ করিনি। ছ’ঘণ্টা ধরে জেরার মুখে পড়তে হয়েছে, কিন্তু কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি।”
📜 কেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন?
দেবাঞ্জনবাবুর দাবি, তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ আবেদন ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
প্রথমটি তাঁর বাবার সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের বকেয়া টাকা সংক্রান্ত। মার্চ মাসে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তিনি রাজ্য সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর পরিবার এখনও সরকারি প্রকল্পের টাকা পায়নি।
তিনি বলেন, “নবান্নে একাধিকবার আবেদন করেও কোনও ফল হয়নি। তাই সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছিলাম।”
দ্বিতীয় আর্জির বিষয়ে তিনি মুখ খোলেননি। শুধু বলেন, “এটা ব্যক্তিগত বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী জানলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।”
এয়ারগান নয়, ‘ভুল বোঝাবুঝি’
প্রাথমিকভাবে পিস্তল দেখে পুলিশ আতঙ্কিত হয়। স্থানীয়রাও ভয় পেয়ে যান। কিন্তু পরে দেখা যায়, এটি একটি এয়ারগান, যা মূলত শুটিং প্র্যাকটিস বা পাখি শিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়।
দেবাঞ্জনবাবু জানান, “আমি প্রায় সাত-আট মাস ধরে নিজের কাছে এই এয়ারগান রাখি। অপরাধীদের সঙ্গে কাজ করতে হয় বলে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখি। এর বৈধ লাইসেন্স আমার কাছে রয়েছে।”
জেরার পর কী বলল পুলিশ?
লালবাজার সূত্রে খবর, দেবাঞ্জনবাবুর ব্যাগ, কাগজপত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্স খতিয়ে দেখা হয়। তাতে কোনও অসঙ্গতি মেলেনি। তাই তাঁকে রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে এক আধিকারিক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। তাই কোনও অস্ত্র নিয়েই ওই এলাকায় প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। ঘটনাটি নিয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।”
হাজরায় আতঙ্ক, পরে স্বস্তি
ঘটনার সময় হাজরা মোড় ও কালীঘাট এলাকায় পুলিশি তৎপরতা তুঙ্গে পৌঁছয়। যান চলাচল সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়। স্থানীয়রা আতঙ্কে ছিলেন যে কোনও অপ্রীতিকর কিছু ঘটতে পারে।
পরে জানা যায়, এটি একটি ভুল বোঝাবুঝি, এবং দেবাঞ্জনবাবুর বিরুদ্ধে কোনও অপরাধমূলক প্রমাণ মেলেনি। এরপরই এলাকায় স্বস্তি ফেরে।
⚡ মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পৌঁছল শিক্ষকের আর্জি
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দেবাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের দুটি আর্জি ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে।
প্রশাসনিক মহলে গুঞ্জন, রাজ্য সরকার এই ঘটনাকে ‘নিরাপত্তা সতর্কতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভবিষ্যতে মুখ্যমন্ত্রীর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে।
শিক্ষক দেবাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পিস্তল সদৃশ এয়ারগান নিয়ে হাজরায় আটক
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন
থানায় ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুক্তি
অস্ত্রের বৈধ নথি দেখিয়েছেন, অপরাধমূলক কিছু মেলেনি
ব্যক্তিগত আবেদন পাঠানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে
কলকাতার মতো স্পর্শকাতর এলাকায় এমন ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠছে। যদিও ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত ভুল বোঝাবুঝিতেই সীমাবদ্ধ, তবুও প্রশাসন এখন আরও সতর্ক। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয় ঘিরে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে শহরে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।