শৌভিক তালুকদার। কলকাতা সারাদিন।
দার্জিলিং পাহাড়ে গোর্খা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সম্পূর্ণ ‘অবৈধ, অসাংবিধানিক ও একতরফা৷’ এমন বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে রাজ্য সরকারের তরফে তীব্র আপত্তির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দার্জিলিং, কালিম্পং ও কার্শিয়াং অঞ্চলের সমস্যা ও দাবি-দাওয়ার বিষয়টি দেখতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস আধিকারিককে ইন্টারলোকিউটর বা ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কড়া ভাষায় চিঠি পাঠালেন মমতা।
চিঠিতে মমতার মূল বক্তব্য, দার্জিলিং অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ২০১১ সালের গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যাক্টের অধীনে কাজ করে। এই আইনটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা কর্তৃক পাস হয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর ১২ মার্চ, ২০১২ তারিখে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। এই আইনটি দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্শিয়াং মহকুমায় স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই আইনের ২(জ) ধারায় বলা হয়েছে যে এখানে ‘রাজ্যপাল’ বলতে বাংলার সরকারকে বোঝায়। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের এই অঞ্চলের জন্য কোনও মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করার কোনও ক্ষমতা নেই। গত ১৬ অক্টোবর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দার্জিলিং পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলির সাথে আলোচনা এবং তাদের রাজনৈতিক দাবিগুলির জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার পঙ্কজ কুমার সিংকে নিযুক্ত করে। পঙ্কজ সিং সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর (বিএসএফ) প্রধান এবং প্রাক্তন উপ-জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টাও ছিলেন। তার বিরোধিতা করে গত মাসেই মোদীকে চিঠি লেখেন মমতা। তাঁর বক্তব্য ছিল, গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) এলাকার প্রশাসন, শান্তিরক্ষার বিষয় সরাসরি রাজ্য সরকারের আওতাভুক্ত। কিন্তু তা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা করা হয়নি। একতরফা ভাবে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করা হয়েছে, যা সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনার উপর আঘাত। সোমবার প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, তার বিষয়বস্তুও একই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে পাঠানো চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপের পরেও, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ১০ নভেম্বরের একটি চিঠিতে জানিয়েছে যে, মধ্যস্থতাকারীর দফতর ইতিমধ্যেই কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। এটা বিস্ময়কর। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, আমার চিঠির কোনও উত্তর ছাড়াই এবং আপনার হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ আলোচক, ১০ নভেম্বর তারিখের একটি স্মারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে আলোচকের কার্যালয় কাজ শুরু করেছে। এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি স্বেচ্ছাচারী এবং একতরফা সিদ্ধান্ত, বাংলা সরকারের সাথে কোনও পরামর্শ ছাড়াই। এটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। এই আদেশের ভারতের সংবিধান বা অন্য কোনও বৈধ বিধানে কোনও ভিত্তি নেই।’
২০১১ সালে পাহাড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যস্থতায় জিটিএ তৈরির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা। আগের চিঠিতেই প্রধানমন্ত্রীকে তিনি লিখেছিলেন, ‘গোর্খাদের নিজস্ব পরিচিতি বজায় রেখে, সব অংশের সম্প্রীতি রক্ষা করে পাহাড়ের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই ছিল জিটিএর লক্ষ্য।’

মমতার মতে, কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ শুধু আইনি কাঠামো ভাঙছে না, বরং দার্জিলিং পাহাড়ে দীর্ঘদিনের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে অস্থিতিশীল করে তোলার সম্ভাবনাও তৈরি করছে। তিনি দাবি করেছেন, ২০১১ সালের পর থেকে পাহাড়ে যেভাবে শান্তি ও উন্নয়ন এগিয়েছে, তা রাজনৈতিক স্বার্থে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে কেন্দ্র। পাহাড় সম্পর্কিত ‘একক সিদ্ধান্ত’ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘পাহাড়ে কষ্টার্জিত শান্তির পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে গোর্খা বা জিটিএ সম্পর্কিত যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।’