সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
বিশ্ব বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সহ লন্ডনের তিন তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া সেখানে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি রয়েছে তাঁর। সফরসঙ্গী হিসেবে যাচ্ছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থও। তার আগে বৃহস্পতিবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সেখানে সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে বলা হয় বিদেশে থাকাকালীন বিক্ষোভ দেখানো হবে বলে খবর রয়েছে। তা শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “তাহলে তো আমারই লাভ। পাবলিসিটি পাব। বিদেশ সফরে আমি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করি। বাংলার হয়ে যাই। আমার অসম্মান মানে বাংলার অসম্মান। যাঁরা ডেকেছেন তাঁদের অপমান করা হবে।”
এরপরই বিরোধীদের তোপ দেগে তিনি বলেন, “আগেও করেছে। ২০১৫ সালে করেছিল ‘১৬তে জবাব পেয়েছে। ২০২৫-এ করবে ‘২৬-এ জবাব পাবে। হিংসার কোনও ওষুধ নেই, কুৎসার কোনও ওষুধ নেই, চক্রান্তের কোনও ওষুধ নেই, এদের ওষুধ একটাই, মানুষের জবাব। মানুষ এদের উত্তর দেবে।”
বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে বৃহস্পতিবার নবান্ন থেকে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বলেন, “আমাদের কোনও নেতা যখন বাইরে যান, আমরা তাঁদের অসম্মান করি না। অবমাননাকর কিছু লিখি না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, কিছু গণশত্রু রয়েছে, গোটা দেশে তো বটেই, আমাদের রাজ্যে বিশেষ করে…নোংরা খেলা খেলছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং ইমেলের মাধ্যমে খসড়া তৈরি করে পাঠাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে বলা হচ্ছে, আমরা বাংলার লোকজন খুব খারাপ।”
মমতা আরও বলেন, “আমার কোনও সমস্যা নেই। আমার বিরোধী হলেও, ওদের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। আমার কোনও দুঃখ নেই। প্রথম থেকে লড়াই করে আসছি। আমার লড়াইয়ের কথা তাঁরা জানেন। কাদের জন্য আমি প্রায় মারা যাচ্ছিলাম? এদের জন্য, যারা চিঠি লিখছে, পাঠাচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছড়াচ্ছে। বাংলাকে এভাবে অপমান না করে, বাংলা মাকে যদি অসম্মান করতে চান কেউ, বলব, আমাকে অসম্মান করুন। বাংলার মাকে অসম্মান করবেন না, বাংলার মাটিকে অসম্মান করবেন না। এর জবাব মানুষ আপনাদের দিয়েছে অনেক বার, আবার দেবে। আমরা কিন্তু ইমেলগুলি পাঠিয়েছি, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজও আছে কিছু কিছু।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্ট জেভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এর পক্ষ থেকে তাকে ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হলেও তিনি তা ব্যবহার না করে সাধারণ মানুষের মতোই থাকতে চান বলে জানিয়ে মমতা বলেন, “আমাকে বলুন, আমার ডিগ্রি কখন ব্যবহার করেছি আমি? সেন্ট জেভিয়ার্স আমাকে সাম্মানিক ডিলিট দিয়েছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও দিয়েছে। আমি কি নামের আগে ডক্টরেট লিখি? আমি লিখি না। যদি পড়াশোনা করে থাকি, যদি ভিখারিও হই, আমি অতি সাধারণ হলেও… আমি যদি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি। কিন্তু সাধারণ বলে অপমান করতে পারেন না। শিক্ষার অধিকার মানবসভ্যতার, মানবিকতার। শিক্ষা অপমান করতে শেখায় না। আমাকে অসম্মান করতে গিয়ে আমার মাতৃভূমিকে অসম্মান করবে না। আমার বিনীত অনুরোধ।”
বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, “অন্য দেশ থেকে ইমেলগুলি পেয়েছি ভার্চুয়ালিও অনেকে থাকছেন। গণশত্রুরা কী ভাবে, আমার পরিচিত কেউ নেই? আমাদেরও পরিচিত অনেকে বিদেশে থাকেন। আমাদের অফিসারের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করেন। আমি নিশ্চয়ই চাইব না, তাঁরা আপনাদের বিরুদ্ধে একই কাজ করুন। আসলে ঈর্ষার কোনও ওষুধ নেই। আমাদের আবিষ্কার করতে হবে। এসব চালাকি কখনও কখনও চলে যায়, কিন্তু সর্বদা চলে না। কখনও কখনও মানুষকে বোকা বানানো যায়, চিরকাল যায় না।”
বর্তমানে বাম, উগ্র বাম এবং সাম্প্রদায়িক দলের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই বলেও দাবি করেন মমতা। বাংলার নির্বাচনে ছাপ্পাভোট হয় বলে মিথ্যে প্রচার হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। মমতা জানান, রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের নজরদারিতে, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হয়। তিনি জানান, সাহস থাকলে সরাসরি তাঁকে প্রশ্ন করা উচিত। নিজের ব্যাপারে মমতা বলেন, “আয়্যাম ভেরি বোল্ড, ভেরি স্ট্রং, আই হ্যাভ দ্যাট কনফিডেন্স। আমি শুধু গণশত্রুদের ব্যাপারে জানিয়ে গেলাম।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নীতি আয়োগের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন বারবার যাওয়া উচিত বিনিয়োগ আনার জন্য। ওঁর কথাকে সন্মান জানিয়ে যাচ্ছি। আমি কেন্দ্রকে বলব ক্লিয়ারেন্স দিতে। এর আগে যখন চিন যেতে চেয়েছিলাম, তখন ক্লিয়ারেন্স দেয়নি।”
তিনি বলেন, “যদি বিক্ষোভ হয় করুক। জানবেন আমাকে যদি অসম্মান করা হয়, সেটা বাংলার অসম্মান করা হবে। মানুষ এর উত্তর দেবে। কোথাও কোথাও বলা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমকে ধরে আমি মারি। আচ্ছা আপনারা এখানে যে স্বাধীনতা পান অন্য কোথাও পান? এখানে যে গণতন্ত্র আছে, আর কোথাও তা নেই।”
মমতা বলেন, “বাংলার ছেলে মেয়েরা খুবই ট্যালেন্টেড। আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা খুবই ভালো। আশা করব আমাদের কোনও নেতা যখন দেশের বাইরে যায়, তাঁকে কোনও ভাবে বিড়ম্বনায় ফেলব না বা বিতর্কিত গল্প বানাব না। কিন্তু দুঃখের বিষয় কিছু গণশত্রু আমাদের রাজ্যে আছে, আমাদের দেশেও আছে। যাঁরা ইমেল, হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে নোংরা খেলা খেলে। ইমেল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। এটা খুব খারাপ। আমি কিছু মনে করি না। কারণ, আমি শুরু থেকে লড়াই করে উঠে এসেছি। বাংলা মাকে কেউ যদি এ ভাবে অসম্মান করতে চান, আমাকে বলুন। বাংলার মাকে অপমান করবেন না। মানুষ তো একাধিক বার জবাব দিয়েছে। আমরা সে সব ইমেল পেয়েছি। হিংসার কোনও ওষুধ নেই।”

কয়েকদিন আগেই বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে যেমন বিপুল অংকের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি এসেছে বাংলায় তার ঠিক পরে পরেই মমতার এই লন্ডন সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মমতা বলেন, “ইউকে বিজিবিএসে আমাদের পার্টনার ছিল। জাপান, ক্যানাডা, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া সকলেই বলেছে আমাদের। আমি মনে করি ইউকে-এর সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। পড়াশোনা থেকে সংস্কৃতি, সব ক্ষেত্রেই সম্পর্ক। সরকারে আসার পর যখন প্রথম সিঙ্গাপুরে যাই, দেখি বাংলা সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ইমেজ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। বাংলা মানেই যেন নেগেটিভ। কিন্তু ভুললে চলবে না, ভারত গোটা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাও ভারতের বিভিন্ন অংশ এবং নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড-সহ বিভিন্ন দেশের গেটওয়ে। বাংলার ভৌগলিক অবস্থানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”