সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
রাজ্য বাজেটের পরে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকেও যেন কল্পতরু মমতা। সিনিয়র ডাক্তারদের বেতন থেকে শুরু করে একেবারে জুনিয়র চিকিৎসক পড়ুয়াদের মাসিক ভাতা কারো বাড়ালেন 10000, আবার কারো বাড়ালেন 25000 টাকা। দীর্ঘদিনের বিতর্ক মিটিয়ে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার উপরেও দিলেন বিপুল ছাড়।
এমনকি কিছুদিন আগেই মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে মেয়াদ উত্তীর্ণ স্যালাইন দেওয়ার অভিযোগে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় যে সমস্ত জুনিয়র ডাক্তারদের সাসপেন্ড করেছিলেন তিনি তাদের উপর থেকেও প্রত্যাহার করে নিলেন সেই নির্দেশ। সবে মিলিয়ে সোমবার আলিপুরের ধনধান্য স্টেডিয়ামে রাজ্যের সর্বস্তরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসক এবং চিকিৎসক পড়ুয়াদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখা দিলেন কল্পতরু রূপে।
আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলা তথা গোটা দেশ জুড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলার সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বাংলার অধিকাংশ ডাক্তার এবং জুনিয়র ডাক্তার। স্বাভাবিকভাবেই মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলার ডাক্তারদের একটা বড় অংশের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল ব্যাপকভাবে।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন কিভাবে সেই দূরত্ব মিলিয়ে ফেলা যায়। তাই বড়দিদির মত যাবতীয় বিতর্ককে দূরে সরিয়ে সর্বস্তরের ডাক্তার এবং ডাক্তারি ছাত্রদের কাছে টেনে নিলেন নিজস্ব কৌশলে। ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে এই বৈঠকের আয়োজন করছিল স্বাস্থ্যদফতরের গ্রিভান্স রিড্রেসাল সেল। সেই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অধ্যক্ষ এবং জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকদের। ডাকা হয়েছিল মেডিক্যাল পড়ুয়া, অধ্যাপক, রেসিডেন্ট ডক্টরস ও মেডিক্যাল অফিসারদেরকেও। এরই মধ্যে সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছিল, অভয়ার ন্যায়বিচার-সহ মোট ১১ দফার দাবিও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানিয়েছেন তাঁরা। স্বাভাবিক কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এদিন ফের উঠে এসেছে সেই আরজি কর প্রসঙ্গ।
বৈঠকের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যে বোনটি মারা গিয়েছেন, তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাই। উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাই। আমি নিজে রাস্তায় হেঁটেছি। কড়া শাস্তির দাবি করেছি। অপরাজিতা বিল করেছি। এই সব ঘটনা রুখতে আমার ভাইদের দায়িত্ব দিচ্ছি। এখন তো সবাই এক সঙ্গে থাকেন। সরকার সরকারের কাজ করবে। আপনারাও বোনেদের রক্ষায় এগিয়ে আসুন।”
এদিন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, “ইনটার্ন, হাউস স্টাফ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি-দের ভাতা ১০ হাজার টাকা করে বাড়ানো হল। সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারদের বেতন বাড়ানো হল ১৫ হাজার টাকা করে। ডিপ্লোমা সিনিয়র রেসিডেন্টদের বেতন ৬৫ হাজার থেকে বেড়ে হবে ৮০ হাজার। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সিনিয়র রেসিডেন্টদের বেতন বেড়ে হবে ৭০ হাজার থেকে বেড়ে হবে ৮৫ হাজার। আর পোস্ট গ্রাজুয়েট সিনিয়র রেসিডেন্টদের বেতন বেড়ে হবে ৭৫ হাজার থেকে বেড়ে হবে ১ লক্ষ।চিকিৎসকদের ন্যূনতম ৮ ঘণ্টা সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা দিতে হবে।”
হিসেব অনুযায়ী এই বেতন বৃদ্ধির ফলে টাকার অঙ্ক দাঁড়াল, সিনিয়র ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের বেতন ৬৫ হাজার থেকে বেড়ে হল ৮০ হাজার টাকা। সিনিয়র ডিগ্রি চিকিৎসকদের বেতন বেড়ে হল ৭০ হাজার টাকা থেকে ৮৫ হাজার টাকা। এবং পিডিটি এস আর-দের বেতন বেড়ে দাঁড়াল ৭৫ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা।
২০১১ সালে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্যে আমূল বদল করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। সরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প-সহ একাধিক সুবিধা পান রাজ্যবাসী। সেসব কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ”বাম আমলে স্বাস্থ্যের দিকে একেবারে নজর দেওয়া হয়নি। তখন মানুষ ঠিকমতো পরিষেবা পেতেন না। এখন আমি নিজের হাতে দপ্তরটা নিয়েছি। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে উন্নত করেছি। এখন আর চিকিৎসার অভাবে কারও সমস্যা হয় না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে দূরে পাড়ি দিতে হয় না। সব জায়গায় সেই ব্যবস্থা করেছে সরকার।”
তিনি এও বলেন, “স্বাস্থ্যসাথীর সাফল্যে ডাক্তারদের বিরাট অবদান রয়েছে। বাংলায় এখন দেশের সেরা গণ-পরিকাঠামো। সরকারি হাসপাতালে ইতিমধ্যেই ৪০ হাজার বেড বেড়েছে। পাশাপাশি ডাক্তারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২৫ হাজারের বেশি নার্সের সংখ্যাও বেড়েছে। জেলা হাসপাতালগুলিকে বলি, হঠাৎ করে রেফার করবেন না। কারণ কলকাতায় সামলানো অসুবিধা হয়ে যায়। কলকাতায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কিছু দুষ্টু লোক আছে, যারা কাজের কাজ করে না। যারা অকাজ করে। একটা মামলা ঠুকে দিল, আর সব আটকে রইল। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের টিকায় বাংলা এক নম্বরে। সরকারি ডাক্তারদের অবসরের বয়স ৬০ থেকে ৬৫ বছর করা হয়েছে। মহিলা ডাক্তারদের জন্য ৫ টি হোস্টেল তৈরি হচ্ছে। আমাদের পাওনা অনেক টাকা পয়সা বন্ধ রাখা হয়েছে। জিএসটির যে ভাগ রাজ্যের পাওয়ার কথা, তা আমরা পাই না।”
হাসপাতালের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সরব হন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হাসপাতালের নিরাপত্তায় এক্স সার্ভিসম্যানদের রাখা হোক। পুলিশকেও নজরদারি বাড়াতে হবে। পুলিশকে মোবাইল ভ্যান আরও বাড়াতে হবে। আজকাল সাইবার ক্রাইম হচ্ছে। সেই অপরাধ ঠেকাতে পুলিশকে সাইবার ট্রেনিং দিতে হবে। গলির কোনায় কোনায় ওয়াচ টাওয়ার লাগাতে হবে। দরকার হলে সাংসদ, বিধায়কদের তহবিল থেকে টাকা নিয়ে ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হোক।”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, মেদিনীপুরের ঘটনায় নিশ্চিতভাবে গাফিলতি ছিল। পুলিশ তার তদন্ত করছে। তবে যাঁরা জুনিয়র ডাক্তার তাঁদের উপর সিনিয়ররা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই তাঁদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর থেকে সাসপেনশন প্রত্যাহার করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সোমবারও জানান, ‘সেদিনের ঘটনায় অবশ্যই গাফিলতি ছিল। সেটা তদন্ত হচ্ছে। জুনিয়র ডাক্তারদের কয়েকজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। তাদের রিপোর্টও পুলিশ পেয়েছে। এটাও ঠিক, তাঁরা এখনও পাকাপোক্ত হয়নি। তাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে যাওয়াটাও ঠিক হয়নি একতরফা ভাবে। তাই তাঁদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি সাসপেনশন তুলে নিচ্ছি।’
চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে সাফ বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এদিন সম্মেলন থেকে মমতা সিনিয়র চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, “সিনিয়র ডাক্তারদের অনুরোধ করব দয়া করে সবটা জুনিয়রদের ওপর ছেড়ে দেবেন না। অন্তত আট ঘণ্টা সরকারি পরিষেবা দিন। তারপরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করুন, তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি আপনাদের জন্য বেঁধে দেওয়া ২০ কিলোমিটারটা ৩০ কিলোমিটার করে দিলাম। কারণ কলকাতায় ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে অনেক হাসপাতাল আছে। কিন্তু সরকারি পরিষেবা দেওয়ার সময় প্লিজ যাবেন না। দরকার হলে হাসপাতালে ডেকে নিন। আমাদের তো পরিকাঠামো আছে। সেখানে যা করার করুন।”

রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার সাফল্য তুলে ধরে মমতা বলেন, “স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে ৯ কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে। চিকিৎসকদের অবদান এতে অপরিসীম। আমাদের আমলে দেশের সেরা হাসপাতাল পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে। ১৩,৫০০-এর বেশি সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ৪০ হাজার বেড বেড়েছে।” তিনি উল্লেখ করেন, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরে ইঞ্জেকশন প্রয়োগে বাংলা দেশে এক নম্বরে রয়েছে। তবে জাল ওষুধের সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “জাল ভিডিওর মতো জাল ওষুধও বেরোচ্ছে। তিন মাস পরপর ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের এক্সপায়ারি ডেট দেখতে হবে।”

বাংলার চিকিৎসকদের বিদেশে চলে না যাওয়ার আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলায় এখন সবকিছু আছে, বাইরে গিয়ে লোহার শিকল-বেড়ির অপমান কেন সইবেন? বাংলায় থেকে মানুষের সেবা করুন। কোনও সমস্যা হলে আমাদের জানান, আমরা আপনাদের পাশে আছি।”
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রতুলদা কদিন আগেই অসুস্থ ছিলেন, চিকিৎসকরা সাধ্যমতো তাঁকে সারানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার পরেও দু’দিন কোনও সাড়া ছিল না প্রতুলদার, কারও সঙ্গে কথা বলেননি। আমি আইসিইউ, আইটিইউ-তে এমনিতে কাউকে দেখতে যাই না, ভাল লাগে না। কিন্তু প্রতুলবাবুর কথা জানার পরে মনে হল, একবার গিয়ে দেখি।”

মমতা আরও বলেন, “আমার সঙ্গে সুপার মণিময় ছিলেন, সাংবাদিক বিশ্ব ছিলেন। আমি গিয়ে প্রতুলদাকে ডাকলাম, প্রতুলদা, আমি মমতা। উনি চোখ খুললেন, জলে ভরা। অনেক সময় সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট এভাবেই ফিরিয়ে আনে। আমি প্রতুলদার আঙুল টিপে দিচ্ছিলাম, পাল্সটা বদলে গেল, ৯৫ থেকে ৯৩। ডাক্তাররা বললেন, উনি যে রেসপন্ড করলেন, তাতে ওঁর স্ট্রেস হচ্ছে। আমি প্রতুলদাকে বললাম, আপনাকে গাইতে হবে, আপনি চলে গেলে বাংলায় গান গাই-টা কে গাইবে? উনি দুটো হাত তুলে বললেন… হয়তো আমায় আশীর্বাদ করলেন, বা হয়তো বললেন, আর পারবেন না গাইতে। আমিও বুঝলাম, উনি আর পারবেন না, আর কোনও উপায় নেই। উনি তো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। আগেও চিকিৎসা হয়েছে, সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন। এবার আর হল না। মানুষ মারা গেলেও, তাঁর মধ্যে একটা বোধ থাকে। মরণের পরে বইয়ে আছে সে কথা, আমি সেই থেকেই জেনেছি। একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরে, বাড়ির লোকেরা কাঁদলেও তিনি বুঝতে পারেন। তবে এগুলি সবই রিসার্চের ব্যাপার। আমি মানবিকতার কথা বলছি।”

গত মাসেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমকে। আর এবার চিকিৎসকদের বৈঠকে, তাঁদের সামনেই স্বাস্থ্য সচিবকে সিরিয়াস হতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার ধনধান্য সভাঘরে ডাক্তারদের নিয়ে বৈঠক করেন মমতা। উপস্থিত ছিলেন প্রায় ২৫০০ চিকিৎসক। তাঁদের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মঞ্চ থেকেই স্বাস্থ্য সচিবকে মমতা বলেন, “নারায়ণ তোমাকে বলব আরও একটু সিরিয়াস হও। তোমাকে তো অনেকগুলো আইএএস অফিসার দেওয়া হয়েছে। তোমাদের নিজেদের মধ্যে অনেক ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন (মতভেদ) হয়। তোমরা আরেকটু নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিও।”