সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
১০০ বছর ধরে ওখানে ইদের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। আপনারা আপনাদের তেমন ইতিহাস দেখান। অন্য ধর্মের লোককে ওই জায়গায় অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয় বলেই হনুমানজয়ন্তীতেও দিতে হবে, তার কোনও যুক্তি নেই। ওই এলাকায় ইদের নামাজ বহু বছর ধরে হয়ে আসছে। খিলাফত আন্দোলনের পর থেকেই ওখানে চলে আসছে শতবর্ষপ্রাচীন এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান। রেড রোডে এবারে হনুমান জয়ন্তী পালন করতে দিতে হবে বলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আবেদন খারিজ করে এমন পর্যবেক্ষণ জানালো কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ।
আগেই রেড রোডে হনুমান জয়ন্তী পালন করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে অনুমতি খারিজ করার পরেই সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের বেঞ্চের মামলা দায়ের করে ভাজপা ঘনিষ্ঠ হিন্দু সেবা দল নামে একটি সংগঠন। তাদের পক্ষ থেকে কলকাতা পুলিশের নির্দেশকে অনৈতিক বলে অভিযোগ করে দাবি করা হয় রেড রোডে যদি ঈদের নামাজ বা ২৬ শে জানুয়ারি ও ১৫ ই আগস্ট এর প্যারেডের মতো অনুষ্ঠান হতে পারে তাহলে হনুমান জয়ন্তীর অনুষ্ঠান পালন করা যাবে না কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ জানান, মিছিলের অনুমতি দেওয়া যাবে না। মূলত যানজটের আশঙ্কাতেই ওই এলাকায় মিছিল করা যাবে না। পাশাপাশি, আদালতের আরও পর্যবেক্ষণ, এ ছাড়া, রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ওখানে প্রতি বছর কার্নিভাল হয়। অথচ, হনুমানজয়ন্তীর অনুষ্ঠান তো আগে কখনও হয়নি। তাই ওখানে মিছিলের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
আগামী ১২ এপ্রিল, শনিবার হনুমানজয়ন্তী উপলক্ষে বেলা ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রেড রোডে মিছিল করার কর্মসূচি নিয়েছে ভাজপা ও তাদের সহযোগী কয়েকটি সংগঠন। তবে যানজটের মতো সমস্যা দেখিয়ে মিছিলে অনুমতি দেয়নি পুলিশ। এর পরেই কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় তারা। তাদের বক্তব্য হল, ওখানে সারা বছর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। অথচ তাঁদের মাত্র তিন ঘণ্টার মিছিলে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না কেন? বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, এর আগে কোনওবার এমন অনুষ্ঠান করেননি। তাহলে এবার কেন? ওখানেই করার তাৎপর্য কী? মামলাকারীর আইনজীবী রাজদীপ মজুমদার বলেন, হনুমানের জন্মদিন। তাই নির্দিষ্ট ওই দিনে করতে চাই। এই বিষয়ে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত বলেন, তাদের অধিকার কোথায়? তাতে বিচারপতি বলেন, অনেক আগে ঈদের অনুষ্ঠান শহিদ মিনারে হত। পরে বৃষ্টির জন্য জল জমায় রেড রোডে অনুমতি দেওয়া হয়। প্রায় ১০০ বছর বা তারও বেশ কিছু আগে খিলাফত আন্দোলনের সময় থেকেই রেড রোডে ঈদের নামাজের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। মামলাকারীর পক্ষ থেকে তখন দাবি করা হয় কলকাতা পুলিশ অনুমতি না দিলেও যেহেতু রেড রোড এলাকার মালিক ভারতীয় সেনাবাহিনী, তারা ইতিমধ্যেই এই অনুষ্ঠানের জন্য অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এই যুক্তি শোনার পরেই দৃশ্যত ক্ষুব্ধ বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, সেনাবাহিনী যদি অনুমতি দিয়েছে তাহলে আপনারা ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে অনুষ্ঠান করুন। আদালতে এসেছেন যখন আদালতের নির্দেশ শুনতে হবে।
সিঙ্গেল বেঞ্চে তাদের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরেই হিন্দু সেবা দলের তরফে সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ জানানো হয় কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। সেখানেও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা টেনে আদালতে অনুমতি চাওয়া হয়। ডিভিশন বেঞ্চে মামলা হওয়ায় বিরক্তি প্রকাশ করেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম।

প্রধান বিচারপতি এদিন স্পষ্ট বলেন, ধর্মীয় বিষয়টিই এই আবেদনে প্রধান। একক বেঞ্চের বিচারপতির মনে হয়েছে, এটা প্রথম হতে চলেছে। প্রতি বছর হলে বাধা দেওয়া হত না। আমাদেরও তাই মত। তিন হাজার লোকের আয়োজন হলেও গোটা দিন ওই রাস্তা ব্লক হয়ে যাবে। আমরা চাই না এটা হোক। মামলাকারীর আইনজীবী রাজদীপ মজুমদারের দাবি, যেখানে পুজোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা নিউট্রাল লোকেশন। সেখানে কোনও অসুবিধা হবে না। ছট পুজোতেও বাধা দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। এই যুক্তি শুনে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেন, ছট পুজোয় মানুষ আসেন ফ্লোটিং ভাবে। মামলাকারীর আইনজীবী বলেন, ১৫ আগস্ট আর ২৬ জানুয়ারির সময়ও দক্ষতার সঙ্গে যান নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। এ কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই দিনগুলির কথা বলবেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বলিদানের কারণেই আমরা আজকে এখানে আছি। আপনি সেলুলার জেলে যান, দেখবেন ৮০ শতাংশ বাঙালির নাম লেখা আছে। আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত।
এর পরেই সিঙ্গেল বেঞ্চের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের নির্দেশ বহাল রেখে প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন, রেড রোডে নয়, শহিদ মিনার বা আর আর অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে বেছে নিতে হবে জায়গা। অনুষ্ঠানস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।