সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“এক বিজেপি নেতা এসে বলেছিলেন যে, বন্ধ চা বাগান সব খুলে দেবেন। একটাও খুলতে পারেননি।” এভাবেই আজ উত্তরবঙ্গের প্রশাসনিক সভা থেকে উত্তরবঙ্গের চা বাগান খোলার বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির নাম না করে তীব্র আক্রমণ করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৬ সালে শিলিগুড়িতে নির্বাচনী প্রচারে এসে বন্ধ চা বাগান অধিগ্রহণের আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও এখনও একটিও চা বাগান অধিগ্রহণ করেনি কেন্দ্র সরকার।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন জানান, রাজ্য সরকার আলিপুরদুয়ার জেলায় আটটি ও জলপাইগুড়ি জেলায় সাতটি চা বাগান খোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজ্য সরকার ৫৯টি বন্ধ চা বাগান খুলেছে। শেষে সাধারণ মানুষের জন্য বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, “যারা মিথ্যে কথা বলে, কুৎসা করে, অপপ্রচার করে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করে তাদের আমি সমর্থন করি না। আমি বিভেদ নয়, ঐক্য চাই।”
শিলিগুড়িতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উত্তরবঙ্গের অনুন্নয়ন, চা-বাগান নিয়ে মিথ্যা প্রচার এবং রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের আর্থিক বিরোধের মতো বিষয়গুলি তুলে ধরেন তিনি। মঙ্গলবার শিলিগুড়ি সংলগ্ন ফুলবাড়ি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ভিডিয়োকন ময়দানের প্রশাসনিক সভা থেকে উত্তরের বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলন নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কত বিনিয়োগ হয়েছে সেটা বলা হয়নি। আপনি কে যে আপনাকে বলতে হবে? কে কোন ব্যবসা করবেন, কোথায় করবেন, কত খরচ করবেন এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। জানেন কী শুধুমাত্র দেউচা-পাঁচামিতে কত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে? উত্তরবঙ্গে আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার তৈরি করতে কত বরাদ্দ হবে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? উত্তরবঙ্গে আগে কী ছিল? মানুষের কান্না। আর কোনও উন্নয়ন ছিল না। একটার পর একটা নাম যদি বলি জায়গা হবে না।”
সরকারি প্রকল্প ও অনুন্নয়নের অভিযোগ
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “৯৭টা সরকারি প্রকল্প আছে। টাকাটা আপনারা চোখে দেখতে পান না। কিন্তু যে পায় সে বোঝে এটার মর্ম কতটা। আসলে দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের মর্ম বুঝি না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদনাম করতে গিয়ে সারাদিন রাজ্য সরকারকে গালি দিচ্ছেন। আর বাংলাকে অপমান করছেন। বাংলার মানুষ তা সবসময় মানবে না। আমরা সেনাকে স্যালুট জানাই। আর মাটির মানুষকে স্যালুট জানাই।”
২ লক্ষ মানুষকে সরকারি পরিষেবা প্রদান
এদিন মূলত ওই অনুষ্ঠান থেকে প্রায় ২ লক্ষ মানুষকে সরকারি পরিষেবা তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। যার মধ্যে বাংলার বাড়ির ১২ লক্ষ উপভোক্তাদের দ্বিতীয় কিস্তিতে মোট ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ও ১৫৮ কোটি টাকা শস্যবিমা খাতে চাষিদের হাতে তুলে দেন তিনি। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রায় দুশো কোটি টাকার প্রকল্পের শিলান্যাস করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ ও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ
এদিনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, বুলুচিক বরাইক, উদয়ন গুহ, মলয় ঘটক, শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব-সহ অন্যান্যরা। এদিন খোলা মঞ্চ থেকেই প্রকাশ্যে কেন্দ্র সরকারকে একহাত নেন মুখ্যমন্ত্রী। বরাবর বিজেপি ও বিজেপির জনপ্রতিনিধিরা উত্তরবঙ্গের প্রতি রাজ্যের অনুন্নয়ন ও বঞ্চনার অভিযোগ তুলে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলে থাকেন। এমনকি সোমবার শিলিগুড়িতে আয়োজিত শিল্প সম্মেলনকেও কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা। যে কারণে এদিন বিরোধীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রীকে।
শিলিগুড়িতে বিরোধীদের প্রতি আক্রমণ আরও তীব্র করে মমতা বলেন, “বাংলার উন্নয়ন দেখতে পান না। পিঠে কুলো আর চোখে তুলো পরে বসে আছেন। আর বলব? নিতে পারবেন তো? আমি তো ম্যাজিশিয়ান নই। যে গুপি গাইন বাঘা বাইনের মতো টাকা ঝরে ঝরে পড়বে। তা হয় না। টাকাটা আসতে হয়। আমরা প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্র সরকারের কাছে পাই। আজকে তা সত্ত্বেও একটাই ট্যাক্স জিএসটি। কেন্দ্র সরকার সংগ্রহ করে। আমরা সাহায্য করি। সেই টাকাটাও আমরা ঠিকমতো পাই না। তা ছাড়াও শিল্পপতিদের কাছ থেকে মিউটেশন ট্যাক্স, গাড়ি চললে তার ট্যাক্স নেওয়া হয়। এগুলো নেওয়া যাবে না। যে কোনও একটা ট্যাক্স। দুটো ট্যাক্স হতে পারে না। আর কত টাকা চাই।”
পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উত্তরবঙ্গ সফরে ফের একবার মানবিকতার বার্তা দিলেন। শিলিগুড়ির ডাবগ্রামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, শুধুমাত্র ডিগ্রি থাকলেই সব হয় না, বরং সমাজে সেই শিক্ষার ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জন্য কাজ করাই প্রকৃত শিক্ষার প্রতিফলন। তিনি বলেন, “ডিগ্রি কার্যকরী তখনই হয়, যখন সেটা মানুষের ভালোর জন্য ব্যবহৃত হয়।” কৃষিকাজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বোঝান, বাস্তব অভিজ্ঞতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। “আলু চাষ করতে হলে বীজ বোনা থেকে শুরু করে সবটাই হাতে-কলমে জানতে হয়”, বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের দর্শন। তিনি জানান, “আজ পর্যন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। আমি যখন রাস্তা দিয়ে যাই, মানুষের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারি কে সুখে আছে, কে দুঃখে।” তিনি আরও বলেন, “দোকানগুলো দেখি, রাস্তার আলো খারাপ আছে কি না দেখি, কোনও একজন মানুষ থাকলেও নমস্কার করতে ভুলি না-সে আমার বিরোধী হোক বা সমর্থক।” গালিগালাজ নিয়েও মুখ খুলেছেন তিনি-বলেছেন, “ওদের গালি দেওয়ার অধিকার আছে, আমার সহ্য করার অধিকার আছে।”