সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“বিজেপি সকল বাংলাভাষী লোককে বাংলাদেশী রোহিঙ্গা বলে, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে বাস করে। এখানে, পশ্চিমবঙ্গের সকল নাগরিকের যথাযথ পরিচয়পত্র রয়েছে। বাংলার বাইরে যাওয়া শ্রমিকরা নিজেরাই যায়নি, তাঁদের দক্ষতার কারণে তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে, যারা বাংলা বলতে পারে তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। কেন? পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতের অংশ নয়?” সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের বাংলাভাষী বাঙালিদের বাংলাদেশী বলে অভিযোগে গ্রেফতারের প্রতিবাদে এমন প্রশ্ন তুলে কলকাতার রাজপথে মিছিল করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাঙালি আবেগকে সামনে রেখে বুধবার পথে নামে তৃণমূল। কলেজ স্কোয়ার থেকে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি রাজ্য মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে কলকাতা এবং সংলগ্ন জেলা গুলির বিধায়ক এবং জনপ্রতিনিধিরা পা মেলান মমতার সঙ্গে এই পদযাত্রায়। মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে পদযাত্রা পৌঁছায় ধর্মতলায়।
ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে বিভিন্ন ভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা। মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য সেই রাজ্যে পুলিশ বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁদের আটক করে হেনস্থা করছেন বলে অভিযোগ। মুর্শিদাবাদ, দেগঙ্গা এরকম একাধিকজনকে বাংলাদেশে পাঠাতে বিএসএফ উদ্যোগীও হয়। পরে তাঁদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনে বাংলার পুলিশ। সাম্প্রতিকভাবে দিল্লিতেও কাজে গিয়ে হেনস্থার শিকার হয়েছেন বাংলার একাধিক পরিযায়ী শ্রমিক। তা নিয়ে হাইকোর্টে মামলাও চলছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা ও বাঙালি আবেগকে সামনে রেখে পথে নেমেছেন নেত্রী ও অভিষেক।
হাতে মাত্র কয়েক মাস। তার পরই বিধানসভা নির্বাচন। এখন থেকেই তার আঁচ অনুভূত হচ্ছে রাজ্য রাজনীতিতে। তবে শুধুমাত্র ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন নয়, ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনও পাখির চোখ বলে এবার জানালেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সরকার রয়েছে, আগামীতেও থাকবে।
এদিন মমতা বলেন, “আমি বাংলায় কাজ করছি। ঠিক আছে। বাংলার মানুষ আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আমাকে বাংলায় কাজ করতে দিন। আমাকে বিরক্ত করলে, গোটা দেশে ঘুরব। আমাকে আটকাতে পারবেন না। দেখব, কোন ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখবেন আমাকে। ওখানে গিয়েও বাংলাতেই কথা বলব আমি। প্রত্যেকের নিজ নিজ মাতৃভাষা আছে। শুধু বাংলা ভাষাকেই অসম্মান কেন? বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলার আত্মত্যাগ ভুলে গিয়েছেন?”
নতুন ভোটারদের সময় মতো তালিকায় নাম তোলার কথা বলেন মমতা। নাম বাদ দেওয়া নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে বলে জানান। আর সে প্রসঙ্গেই বিজেপি-কে একহাত নেন মমতা। বলেন, “মানুষের ভোটাধিকার কাড়ার অধিকার নেই আপনাদের। নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই ফরমান জারি করবেন না। বুক দিয়ে লড়াই করতে হবে। আগামী দিন বাংলা আমাদের আছে, থাকবে। আগামী দিন আমরা দিল্লি দখলও করব সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। ২০২৬ ফর বেঙ্গল, আর তার পর দিল্লির যে নির্বাচন হবে, তা আমাদের ইন্ডিয়া টিমেরই হবে। এটা মাথায় রেখে দিন।”
পর পর রাজ্যে যেভাবে ভোটার তালিকায় রদবদল করা হচ্ছে, তাতে বিজেপি-কে জেতানোর অভিসন্ধি লুকিয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ করেন মমতা। তিনি জানান, নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি বিজেপি-র লোকে ভরে গিয়েছে। ভোটার বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যখন তখন। মহারাষ্ট্র, দিল্লিতে সেভাবেই জেতানো হয়েছে বিজেপি-কে। এখন বিহারে একই কাজ চলছে, আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গেও একই পরিকল্পনা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন মমতা। বলেন, “পুঁটি মাছ, মৌরলা মাছ বাছতে বসেছে যেন! আর তাতে এত ভুল করছে যে কাঁটার মধ্যে কাঁটা ঢুকে যাচ্ছে। খেলা হবে। তৈরি থাকুন।” মমতা জানান, যত খুশি মামলা করতে চায় করুক বিজেপি। তিনি মানুষকে ‘ফেস’ করেন। তাই বিজেপি-র মামলার পরোয়া করেন না।

এদিন নির্বাচন কমিশনকেও একহাত নেন মমতা। বিজেপি-কে জেতাতে, তাদের দালাল হয়ে কমিশন কাজ করছে বলে দাবি করেন। মমতা জানান, যত চেষ্টাই হোক, আগামী দিনে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই হবে। বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমিও ছেডে় দেবেন না।
সাম্প্রতিক অতীতে দিল্লি, মহারাষ্ট্র-সহ একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলার শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলায় কথা বললেই অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ আগেই করেছিলেন। এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা সব ভাষাকেই সম্মান করি। যারা ভারতের নাগরিক, তাঁদের সকলকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু বাঙালির অপমান মানব না। অত্যাচার সহ্য করা হবে না।” বিজেপি বরাবর বিভেদের রাজনীতি করে, ভাষা বিভেদের রাজনীতি করা হচ্ছে বলেও মুখ্যমন্ত্রী এদিন নিশানা করেন। বাংলায় বহু ভাষাভাষির মানুষ বাস করেন। দেশের সব ভাষা ও মানুষদের বাংলা সম্মান করে। কিন্তু কোনওভাবেই বাংলা ভাষার অসম্মান মেনে নেওয়া যাবে না। ভিনরাজ্যে বাঙালির অপমান মেনে নেওয়া হবে না। এদিন পরিষ্কার এই বার্তা দিয়েছেন মমতা। বাংলায় ভাষার সাম্যবাদ আছে। এদিন মঞ্চ থেকে বিজেপিকে ভাষা সাম্যবাদের পাঠ দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, “জমিদারি নাকি? বাংলা বললেই বাংলাদেশি রোহিঙ্গা বলবেন? হেনস্তা করা হচ্ছে, যাদের সকলের কাগজপত্র আছে। শুনে রাখুন, যারা এখান থেকে কাজ করতে বাইরে যান, দক্ষতা আছে বলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। ওরা বাংলায় থাকলে অনেক ভালো থাকত। কিন্তু তাঁরা গিয়েছে। কোন অধিকারে তাঁদের উপর অত্যাচার করা হবে?” খাবারের অভ্যাসেও বিজেপি হস্তক্ষেপ করছে। কোনওভাবেই বিজেপির এই রাজনীতি মেনে নেওয়া যাবে না। সেই কথাও এদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা আরও বলেন, “আমি ঠিক করেছি, আরও বেশি বাংলায় কথা বলব। ক্ষমতা থাকলে আমাকেও ডিটেনশন শিবিরে রাখুন। অসমে ১২ লক্ষ বাঙালি বাদ দিয়েছেন। রাজবংশীরা হিন্দু না মুসলিম? এই বিজেপি-র দালাল, লজ্জা করে না! নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ভোটার বাদ দিয়ে দিচ্ছে। বলছে ২০০২ সালের তালিকা দেখবে। কত লোক তো মারা গিয়েছেন! কত নতুন লোক এসেছেন, কত বাচ্চা জন্মেছে। কে কী পরবে, কে কী খাবে, কে কোথায় থাকবে, কে কোন ভাষায় কথা বলবে, তা ওরা ঠিক করবে!”
মঞ্চ থেকেই মমতা বলেন, “আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করছি। কারণ প্রতিদিনি আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। সেটা আমাদের দেখতে হয়। ভারত সরকার ও বিজেপির আচরণে আমি অত্যন্ত দুঃখিত, লজ্জিত, ব্যথিত।” তীব্র কটাক্ষের সুরে বলেন, “একটা প্রবাদ আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়, শাড়ির চেয়ে চেয়ে গামছা, মন্ত্রীর চেয়ে আমলা বড়, নেতার চেয়ে চামচা! ভারত সরকার একটা নোটিফিকেশন করেছে। আমরা সেটাকে চ্যালেঞ্জ করব।”
মমতার দাবি ওই বিজ্ঞপ্তি গোপনে করেছে বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকার। বলেন, “ওই নোটিফিকেশন লুকিয়ে লুকিয়ে করেছে। ওরা নিজেদের রাজ্য যেখানে বিজেপি আছে সেখানে পাঠিয়েছে। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যাকেই সন্দেহ হবে বাংলা ভাষায় কথা বলে, গ্রেফতার করবে ডিটেনশন ক্যাম্পে (হোল্ডিং এরিয়া) রেখে দেবে। এমনকী কেউ আত্মীয়র বেড়াতে গেলেও!” এরপরই কটাক্ষের ধার বাড়িয়ে আরও বলেন, “আমরা সবাইকে সম্মান করি, কিন্তু বাঙালিদের উপর অত্যাচার হলে আমরা ছাড়ব না। দিল্লিওয়ালো কী ভাবছেন যে আপানারা দেশের জমিদারি নিয়ে নিয়েছেন? যাকে ইচ্ছা জেলা পাঠিয়ে দেবেন? বাংলা ভাষায় কথা বললেই আপনি যাকে ইচ্ছা বাংলাদেশি রোহিঙ্গা বলে দেবেন?”