সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
”কীভাবে চিকিৎসা করাবে মানুষ তাঁরা ভাবে না। ডাক্তার যখন এই ওষুধগুলি লিখবেন তখন গরিব মানুষ তা কিনতে পারবেন না। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার আছে কীসের জন্য? এই সিদ্ধান্ত কি একটি শ্রেণির জন্য নেওয়া হচ্ছে, যারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে পারে? শুধুমাত্র ওদের জন্য সরকার চলবে?” সম্প্রতি দেশজুড়ে যেভাবে প্রায় 900 অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ বুধবার নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলন থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “গতকাল ১ এপ্রিল থেকে ৭৪৮টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই সব ওষুধ গরিব, সাধারণ মানুষ কেনেন। এদের ক্ষমতা নেই বিদেশে গিয়ে কোটি কোটি টাকা দিয়ে চিকিৎসা করানোর। এগুলির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হল। আমি স্তম্ভিত। আমি দুঃখিত ও চিন্তিত। স্বাস্থ্যই সম্পদ। তাই রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যসাথী থেকে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান করেছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ দিতে গিয়ে রাজ্য সরকারের প্রচুর টাকা খরচ হয়। মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে? এক শতাংশ মানুষ, যারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে চিকিৎসা করতে পারেন, শুধুই কি তাদের জন্যই সরকার চলবে? আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করছি। বর্ধিত দাম প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।এখন প্রতিবাদ না করলে স্বাস্থ্য পরিষেবা হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে।”
এর প্রতিবাদেই মানুষকে পথে নামার ডাক দেন। নবান্নে বসেই তৃণমূল সুপ্রিমো বলেন, আগামী শুক্র এবং শনিবার রাজ্যের প্রতি ব্লক এবং ওয়ার্ডে বেলা ৪টে থেকে ৫টা প্রতিবাদ মিছিল হবে। সেখানে সাধারণ মানুষকেও সামিল হওয়ার ডাক দেন। কেন দাম বাড়ানো হচ্ছে, অবিলম্বে ওষুধের দাম কমাতে হবে, এই দাবি ওই মিছিল থেকে তোলা হবে বলেও জানান। আর তা না হলে আগামিদিনে আরও বৃহত আন্দোলনের ইঙ্গিত। মমতা বলেন, বিক্ষোভ আন্দোলনে কাজ না হলে পথ খোলা থাকবে।
সম্প্রতি অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করার সময়ও হিন্দু হওয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল মমতাকে। সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আমাকে বিদেশে গেলে কেন প্রশ্ন করবে আমি কি হিন্দু? ওরা কে? আমি কি বিজেপি-কে উত্তর দিতে দায়বদ্ধ? কালকে আবার ছেড়েছে আমি না কি পদত্যাগ করেছিলাম! আর কত ভুয়ো খবর ছড়াবে! ফেক আর ভেক। আমরা এফআইআর করেছি। যা তা করে বেড়াচ্ছে। এর আগে, বাংলাদেশের ছবিকে মুর্শিদাবাদের বলে চালিয়েছিল, গুজরাত-রাজস্থানের ছবিকে বাংলার বলে চালিয়েছিল। এখনও সেই পরিকল্পনা জুমলা পার্টির। আমি জুমলা পার্টিকে বলব, সত্যিই যদি ধর্মকে ভালবাসেন, বাসন্তী পুজো করুন, নবরাত্রি করুন, অন্নপূর্ণা পুজো করুন। অন্নপূর্ণা পুজোয় আমিও পুজো দিই। যাঁরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিলের নামে দাঙ্গা করেন, ইতিহাসটা জেনে রাখুন। পাঞ্জাবিরাও কৃপাণ নেন। আপনিও ব্যবস্থা অনুযায়ী, পুলিশের নির্দেশ মেনে নিশ্চয়ই পারবেন। কিন্তু অন্য এলাকায় গিয়ে হামলা করা আপনার কাজ নয়।”
মমতা বলেন, “এরা যে রামনবমীতে মিছিল করে, আমাদের অনেকেও রামনবমীতে মিছিল করেন, আপত্তি নেই আমাদের। আমরা শুধু চাই শান্তিপূর্ণ হোক। এখন যেটা চৈত্র মাসে হয়, সেটাই ছিল। কিন্তু রাবণকে ধ্বংস করতে রামচন্দ্র যখন অকাল বোধন করেন যখন, সেটাকেই আসল দুর্গাপুজো হিসেবে পালন করি আমরা। এটাও পালন করি, কিন্তু ওভাবে নয়। সবাই সবার মতো করে নবরাত্রি পালন করবে, পুজো করবে, এটাই ধর্ম। শরতে শিউলি, কাশফুল ভাসে। আমরা করিনি, রামচন্দ্র করেছিলেন। সেটা কি রামনবমী নয়? সেটা কি আপনাদের মনে পড়ে না। রামচন্দ্র ১০৭টা ফুল দিয়ে একটা বাকি ছিল বলে নিজের চোখ দিতে গিয়েছিলেন। ইতিহাসটা জানুন। ইতিহাসের এটাই শিক্ষা। কর্ম মানেই ধর্ম, ধর্ম মানে কর্ম। মানবিক হোন, দানবিক হবেন না দয়া করে।”
বুধবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বলেন, “দরিদ্র মানুষের সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার আছে কী জন্য? শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রবণতার নামে…একটা নতুন ধর্মের আমদানি করে, যা আমাদের তপোবনের নয়, আমাদের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নয়, যা বেদ-বেদান্তের নয়, যা ঋক-সাম-যজু-অথর্বের নয়…শুধু দেশকে ভাগ করার জন্য, মানুষের মধ্যে দাঙ্গা লাগানোর জন্য? আমি চাই, বাসন্তী পুজো, অন্নপূর্ণা পুজো, রামনবমী সব শান্তিতে, ভাল ভাবে হোক। ইদও শান্তিতে পালিত হয়েছে। সামনের সবকিছুও ভাল ভাবে পালিত হোক। নতুন বছর আসছে, শুভ নববর্ষ। আমাদের মা কালীবাড়ির স্কাইওয়াক, উন্নতি হয়েছে। ১৪ তারিখ উদ্বোধন করব। ২৮ তারিখ জগন্নাথ ধামের উদ্বোধন হবে।”
ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল সংসদ। সেই প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “দলের সাংসদরা ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। কারণ জুমলা দলের একটাই কাজ, দেশকে ভাগ করা। ওরা বিভাজনের নীতিতে বিশ্বাসী, আমরা না। আমরা সংবিধান মেনে চলি। আগে সংবিধানকে শ্রদ্ধা কোরো, তার পর অধিকার কাড়তে যেও। মনে রাখবেন, ধর্ম যার যার আপনার, উৎসব কিন্তু সবার। পরিষ্কার বলছি, আমি শ্রীকৃষ্ণের বাণীও শুনি, বিবেকানন্দ, নেতাজি, গাঁধীজি, অম্বেডকর, রামকৃষ্ণ, আবুল কালামও পড়ি। একটাই কথা, কর্ম যার, ধর্ম তার। ধর্ম তখনই সদিচ্ছা লাভ করে যখন কর্ম হয় মানবিক। কর্ম দানবিক হলে কোনও ধর্মকে শ্রদ্ধা করা যায় না। আমি সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি।”
বিজেপি-র পাশাপাশি বামেদের নিশানা করে মমতা বলেন, “বামপন্থীদের সবাইকে বলি না আমি, অনেকে আছেন, যাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি, একসময় যাঁরা করতেন, এখন করেন না। কিন্তু বিজেপি-র দোসর আছেন যাঁরা, তাঁদের বলি যে, গৈরিকীকরণ ও রক্তিমকরণকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেবেন না। আপনারাও বড় বড় সাম্প্রদায়িক হয়ে গিয়েছেন। নির্বাচন থেকে সব ব্যাপারেই বাম-রাম এক, জগাই-মাধাই-গদাই। যত এসব করবেন, তত মহাশূন্য থেকে আরও শূন্যে বিলীন হয়ে যাবেন। আমার অনুরোধ সকলকে, হিন্দু হোন বা মুসলিম হোন, অথবা শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, শান্তি বজায় রাখুন। দাঙ্গা করে অশান্তির চেষ্টা করবেন না দয়াকরে। দাঙ্গা করে কেউ কোনও দিন কিছু করতে পারেনি, আর করবেও না। বাংলা আর যাই হোক না কেন, বাংলা সংস্কৃতির জন্ম দেয়, বাংলা সম্প্রীতির জন্ম দেয়। আমরা রামকৃষ্ণকে মানব, জুমলা পার্টিকে মানব না। মা সরস্বতীর বচন মানব, জুমলা পার্টিকে নয়। যে ধর্ম সকলকে শ্রদ্ধা করে, আপন করে নেয়, সেই ধর্মকে মানি। আমরা সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি। আমরা অন্নপূর্ণা পুজো, বাসন্তী পুজো, রামনবমী, চৈত্র সংক্রান্তি, চড়ক… আরও নানা কিছু হয়। অন্যের উৎসবকে ডিস্টার্ব করতে যাবেন না। আমি সবাইকে নিয়ে চলি, আপনারা কেন পারেন না?”

পাথরপ্রতিমায় বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে আজ, বুধবার নবান্ন থেকে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘ইচ্ছা করেও আগুন লাগাতে পারে, বিমার টাকা পাওয়ার জন্য। সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার আর বাজি কি একসঙ্গে থাকা উচিত? এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সকলের। এক জায়গায় দাহ্য পদার্থ রাখলে যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সরকার সবরকমভাবে প্রস্তুত এই ধরনের বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে। যে কাণ্ড ঘটেছে সেটা দুঃখজনক। কিন্ত ব্যবসায়ী লাইসেন্স হোল্ডার ছিলেন। বাজি ও রান্নার গ্যাস কোনও সময় একসঙ্গে থাকে? এটা থাকা উচিত? বাড়িতে গ্যাস সামলে রাখবে না। একটা ঘটনায় পরিবারের সবাই মারা গেলেন। খুব দুঃখজনক।’