হাতিবাগান, উত্তর কলকাতার এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো দিনের কলকাতা, নাটক-সিনেমা, বইয়ের দোকান, বাজার আর রাজনীতির উত্তাপ।
এই জায়গাটির ইতিহাস শুধু বাজার বা থিয়েটার ঘিরেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ব্রিটিশ আমল, নবাবি শাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী।
নামের উৎস ও নবাবি আমল
‘হাতিবাগান’ নামটি এসেছে ‘হাতি’ ও ‘বাগান’ শব্দ থেকে। ইতিহাসবিদদের মতে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় এই অঞ্চলে হাতির রাখালরা হাতি রাখতেন ও প্রশিক্ষণ দিতেন। সেই থেকেই নামকরণ—‘হাতিবাগান’। তখন এই অঞ্চল ছিল মূলত গাছপালা ও জলাভূমিতে ঘেরা।
ব্রিটিশ শাসন ও শহরের রূপান্তর
ব্রিটিশ শাসনকালে হাতিবাগান ধীরে ধীরে শহরের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে এখানে জমিদার বাড়ি, নাট্যমঞ্চ, বইয়ের দোকান ও কাঁচাবাজার গড়ে ওঠে। ব্রিটিশরা কলকাতাকে তাদের রাজধানী করার সময়, উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলও আধুনিক শহরের রূপ নিতে শুরু করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে হাতিবাগান
হাতিবাগান ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নীরব মঞ্চ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অনেক কর্মসূচি এই অঞ্চলের চায়ের দোকান, নাট্যশালা বা ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ত। বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকে এই এলাকার নাট্যসংঘ, পাঠাগার বা গোপন সভায় অংশ নিতেন।
নাট্যচর্চা ও সাহিত্যে ছাপ
হাতিবাগান মানেই থিয়েটার। এখানে বিখ্যাত ‘স্টার থিয়েটার’, ‘বিজলী থিয়েটার’, ‘নাট্যমন্দির’-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠে। গিরিশ ঘোষ, নটী বিনোদিনী, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, শম্ভু মিত্র—এমন বহু নাট্যব্যক্তিত্ব এই অঞ্চলকে বেছে নিয়েছেন তাদের সৃষ্টির কেন্দ্র হিসেবে। বাংলা সাহিত্যে এই এলাকার প্রভাব দেখা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বনফুলের লেখায়।
বাজার ও আধুনিক হাতিবাগান
হাতিবাগান বাজার কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এবং জনবহুল বাজার। এখানেই আজও পাওয়া যায় পুরনো দিনের পত্রিকা, বই, গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে শুরু করে আধুনিক ফ্যাশনের পোশাক। দুর্গাপূজার আগে এখানকার রাস্তাগুলি হয়ে ওঠে বর্ণময় উৎসবমুখর এক চিত্র।
হাতিবাগান শুধু একখানা বাজার নয়, এটি কলকাতার ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সাহিত্যের এক সজীব পাতা। নবাবি আমলের হাতি থেকে ব্রিটিশ শাসনের নাট্যচর্চা, আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন সভা থেকে শুরু করে আজকের রঙিন মার্কেট—হাতিবাগান যেন এক জীবন্ত ইতিহাস গ্রন্থ। আধুনিক কলকাতায় দাঁড়িয়েও, হাতিবাগান আজও তার প্রাণশক্তি ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।