শৌভিক তালুকদার। কলকাতা সারাদিন।
জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের নিহত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদের জলের চুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
ভারতের তরফে জানানো হয়েছে, যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করছে, ততক্ষণ এই চুক্তি স্থগিত থাকবে।
ভারতের এই কঠোর পদক্ষেপে পাকিস্তান ব্যাপক চাপে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিন্ধু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটলেও অতীতে এই চুক্তি কখনোই রদ করা হয়নি। কাশ্মীরের পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের উপর বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার পরই ভারত এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে খবর।
কী রয়েছে সিন্ধু চুক্তিতে?
এই চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু নদ এবং তার দুই পশ্চিমের উপনদী- বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জলের উপর পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ অধিকার থাকবে। অন্যদিকে, ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তিনটি পূর্বের উপনদী- বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সাটলেজ়) এবং ইরাবতী (রাভি)-র জল। সামগ্রিক ভাবে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলির মোট জলের উপর পাকিস্তানের অধিকার ৮০ শতাংশ এবং ভারতের অধিকার ২০ শতাংশ। চুক্তি অনুযায়ী, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে এই জল ব্যবহার করতে পারলেও কোনও অবস্থাতেই অপর দেশের প্রাপ্য জলপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না।

চুক্তি বদল নিয়ে টানাপোড়েন
১৯৬০ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই দেশের বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জলের চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সিন্ধু চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের কথা ২০২৩ সালে ইসলামাবাদকে জানিয়েছিল নয়াদিল্লি। যদিও, পাকিস্তানের তরফে তখন এই বিষয়ে কোনও সাড়া মেলেনি। এর আগে ২০১৬ সালে পাকিস্তান অভিযোগ তুলেছিল যে, ভারত কিষেণগঙ্গা এবং রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে তাদের প্রাপ্য জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। যদিও ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ জানিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানের প্রাপ্য জল আটকাতে নয়, ভারত নিজেদের প্রয়োজনেই কিষেণগঙ্গা এবং রাতলে প্রকল্প নির্মাণ করেছে।

জল নিয়েই যুদ্ধ?
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত-পাক যুদ্ধ সিন্ধুর জল নিয়েই হয়েছিল। মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বাধীন সরকার কাশ্মীর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিন্ধুর জলের জন্যই। তবে, ১৯৬৫ ও ৭১-এর যুদ্ধের সময়েও দুই দেশই সিন্ধু চুক্তিতে হাত দেয়নি। এমনকী, কার্গিল যুদ্ধের সময়েও এই চুক্তি বজায় ছিল। কিন্তু পহেলগাঁও হামলায় ভারতের মাটিতে প্রবেশ করে নাগরিকদের বেছে বেছে নৃশংসভাবে হত্যা এবং সেই সন্ত্রাসে পাকিস্তানের মদত দেওয়ার বিষয়টি জেনেই ভারত এবার কড়া পদক্ষেপের পথে হেঁটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের ক্ষতি কোথায়?
সিন্ধু চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তান বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের কৃষিকাজে ব্যবহৃত জলের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে সিন্ধু নদ এবং তার পশ্চিমের উপনদীগুলি থেকে। করাচি, মুলতান, লাহোরের মতো বড় শহরগুলিতেও সিন্ধুর জল ব্যবহার করা হয়। জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে পাকিস্তানের কৃষিকাজ ও জলসেচ প্রকল্পের উপর বড় প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানের জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ নির্ভর করে গম, চাল, আখ, তুলার মতো শস্য উৎপাদনের উপর। জলের অভাবে চাষের ব্যাপক ক্ষতি হলে তা পাকিস্তানের সার্বিক জিডিপির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কৃষিকাজ ছাড়াও পাকিস্তানের মাংলা ও তারবেলা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলিও জল সংকটে প্রভাবিত হতে পারে।
করোনা মহামারী এবং ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যায় পাকিস্তানে এমনিতেই তীব্র আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে সিন্ধু চুক্তি বাতিল বা স্থগিত হলে তা পাকিস্তানের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ মনে করছেন। সব মিলিয়ে, পহেলগাঁও হামলার জেরে ভারতের তরফে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে, তা যদি কার্যকর হয়, তবে তা পাকিস্তানের জন্য একটি বড়সড় ধাক্কা হবে।