শোভন গায়েন। কলকাতা সারাদিন।
আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন বিপুল সম্পত্তি। সেই সঙ্গে তদন্তে বিস্তর অসহযোগিতার অভিযোগে প্রভাবশালী তত্ত্বে শনিবার রাজ্যের কারা এবং ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোগ দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহাকে সাত দিনের হেফাজতে চেয়ে আবেদন জানাল ইডি।
বিশেষ ইডি আদালতে শনিবার শুরু হল কারামন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহার বিরুদ্ধে ইডি মামলার শুনানি। আর শুনানির প্রথমেই রাজ্যের কারামন্ত্রীকে ৭ দিনের হেফাজতে চেয়ে আবেদন জানাল ইডি। গত বছর মন্ত্রীর বাড়ি থেকে নগদ ৪১ লক্ষ টাকা উদ্ধারের পরও কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি, তাও জানাল ইডি।
এদিন আদালতে ইডির আইনজীবী বলেন, আমরা সাতদিনের হেফাজতে চাইছি। ২০২৪ সালের মার্চে আমরা নগদ লক্ষ টাকা ও মোবাইল পেলাম। যখন আমরা ৪১ লক্ষ টাকা পেলাম, তখন বুঝলাম তদন্ত আরও জোরালো করলে আরও কিছু তথ্যপ্রমাণ মিলতে পারে। তাই ওই টাকা উদ্ধারের পরই হেফাজতে নেওয়া হয়নি। তদন্ত চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর ইডির আইনজীবী বলেন, মন্ত্রীর কাছে যেসব নথি আগে চাওয়া হয়েছিল, সেগুলো ইচ্ছে করেই দেননি। চার্জশিট জমা পড়ার কয়েকঘণ্টা পরই পাঠিয়ে দেন।
চন্দ্রনাথকে হেফাজতে চেয়ে ইডির আইনজীবী বলেন, উনি খুবই প্রভাবশালী মানুষ। বারবার নোটিস পাঠিয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় না, সেটা উনি একদিনের মধ্যে দিতে পারেন। আমরা এতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম না যে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে হেফাজতে চাইব। মন্ত্রী বলছেন, কৃষিকাজের আয়। জমি বিক্রির আয়। তখন থেকেই আমাদের সন্দেহ বাড়ে।
ইডির দাবি, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন চন্দ্রনাথ। ২০১৬ সালের শেষের দিকে বিপুল অঙ্কের টাকা নগদে নিয়েছিলেন তিনি। ইডি আদালতে জানায়, ২০২৪ সালে বোলপুরে মন্ত্রীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৪১ লক্ষ টাকা নগদ উদ্ধার হয়েছিল। অভিযোগ, তার নির্দিষ্ট কোনও হিসেব দিতে পারেননি চন্দ্রনাথ। আয়কর রিটার্নও জমা দেননি। তবে গত ৬ অগাস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রী হিসেব দিয়েছিলেন। কিন্তু উদ্ধার হওয়া টাকার মধ্যে মাত্র ১৯ লক্ষের হিসেব দেখান তিনি। তদন্তকারীদের দাবি, ওই ১৯ লক্ষ টাকার উৎসও স্পষ্ট নয়। কৃষি কাজ ও রিয়েল এস্টেট থেকে টাকা এসেছে বলে দাবি করলেও তার সপক্ষে কোনও নথি দেখাতে পারেননি মন্ত্রী। ইডির অভিযোগ, শুধু মন্ত্রী নন, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলের অ্যাকাউন্টেও বিপুল অঙ্কের টাকা জমা হয়েছে। চার্জশিটের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পাতায় ইডির দাবি, আয়কর মেটাতে মন্ত্রী ৯০ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই টাকা এল কোথা থেকে, তার কোনও জবাব দিতে পারেননি তিনি। আয়কর রিটার্ন ও প্রকৃত আয়ের মধ্যে বিস্তর গরমিল ধরা পড়েছে।
প্রসঙ্গত, বহিষ্কৃত তৃণমূল যুবনেতা কুন্তল ঘোষের জবানবন্দিতেই প্রথম উঠে আসে মন্ত্রীর নাম। এরপর চন্দ্রনাথের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখে একাধিক বড়সড় লেনদেনের হদিস পায় ইডি। ইডি-র দাবি, প্রায় ১৫৯ জন প্রার্থীর কাছ থেকে গড়ে ৮ লক্ষ টাকা করে নিয়েছিলেন মন্ত্রী। অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ১২.৭২ কোটি টাকা। কিন্তু এত বিপুল অর্থ কোথায় গেল, তার কোনও উত্তর এখনও মেলেনি।
এতদিন তাঁকে গ্রেফতার না করার কারণ হিসেবে ইডির আইনজীবী বলেন, ওঁর সম্পর্কে সব তথ্য জোগাড় না করে গ্রেফতার করতে গেলে ওঁর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সতর্ক হয়ে যেতেন। ওঁর লার্জার কানেকশন আছে। আমরা বাকি তথ্য পেতাম না। এখন আমরা সব তথ্য জোগাড় করেছি। তাই হেফাজতে চাইছি। চন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে ইডির আইনজীবী বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী। তদন্ত বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছেন। তদন্তে সহযোগিতা করেননি। আমরা চন্দ্রনাথ সিনহাকে হেফাজতে চাইছি সুবিচারের জন্য। তদন্ত আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদিন মন্ত্রীর কাছে বিচারভবনের বিচারকও জানতে চান, ইডি যখন আয়কর রির্টানের তথ্য চেয়েছিল, তখনই কেন তিনি তদন্তকারীদের সেই তথ্য জমা দিলেন না? তদন্তে অসহযোগিতার কারণ কী? তবে এর পাশাপাশি এ দিনের শুনানিতে ইডিকে তোপ দাগেন বিচারক। ইডির আইনজীবীকে বিচারক শুভেন্দু সাহাকে প্রশ্ন করেন, ১১ মাস কী করছিলেন? এদিকে আদালত থেকে বেরিয়ে বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা প্রকাশ করে চন্দ্রনাথ সিনহা বলেন, গতকাল থেকে অনেক কিছু বলা হচ্ছে। সকলেই আদালত কক্ষে ছিলেন, কী হয়েছে সব দেখেছেন, শুনেছেন। বিচারব্যবস্থার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

ইডির আইনজীবী আদালতে সওয়াল করে দাবি করেন, যে তথ্য এখন তাদের হাতে এখন আছে তা থেকে অনেক অজানা লিংক পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রীকে হেফাজতে চান তারা। হেফাজতের তীব্র বিরোধিতা করেন চন্দ্রনাথের আইনজীবী। সওয়াল-জবাব শোনার পর মামলার রায়দান স্থগিত রাখেন বিচারক। মন্ত্রী চন্দ্রনাথের আইনজীবী সোমবার সাড়ে দশটায় আদালতে হলফনামা জমা দেবেন। আগামী মঙ্গলবার ইডির মামলায় চন্দ্রনাথের জামিনের আবেদনের রায় শোনাবেন বিচারক।