সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
কয়েকদিন আগেই রাজ্য মন্ত্রিসভার ক্যাবিনেট বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্মৃতিমাখা জয়রামবাটি কামারপুকুর এলাকাকে পর্যটন মানচিত্র তুলে আনার পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য তৈরি হবে কামারপুকুর উন্নয়ন পর্ষদ। মুখ্যমন্ত্রী নিজে হুগলিতে ছুটে গিয়ে একের পর এক প্রকল্পের উদ্বোধন এবং শিলান্যাস করে এসেছেন। এবারে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দিবসে ঘোষণা করলেন শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান হুগলির দেবানন্দপুর উঠে আসছে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক অনন্য নাম। রবীন্দ্রনাথ বা তারাশঙ্করের মতো জমিদার পরিবারে জন্ম নয়, আবার বঙ্কিমচন্দ্রের মতো উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীও নন তিনি। জীবনের একাধিক পর্যায়ে আর্থিক সংকট তাঁকে তাড়া করেছিল। তবুও নিজের সাহিত্যসাধনার মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন—সাহিত্যও হতে পারে জীবিকা। ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে শরৎচন্দ্রের জন্ম। তাঁর পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধারণ মানুষ, সংসারে প্রায়ই অর্থকষ্ট দেখা দিত। ভাগলপুরে মাতুলালয়ে বেড়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র। স্কুলজীবনেই তাঁর লেখালিখির হাতেখড়ি।
কিন্তু আর্থিক কারণে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারেননি। চাকরির প্রয়োজনে তিনি সুদূর বার্মা গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি লেখালিখি চালিয়ে যান। তাঁর লেখা বড়দিদি, দত্তা, দেনাপাওনা ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তিনি জনমানসে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্য সাধারণ মানুষের গল্প। পথের দাবি থেকে শ্রীকান্ত, দেবদাস থেকে পরিণীতা—সবকটি উপন্যাসই মানুষের হৃদয়ে আজও সমান জনপ্রিয়। তাঁর লেখার সহজ-সরল ভঙ্গি, আবেগঘন কাহিনি, এবং সামাজিক সমস্যার সরল উপস্থাপন তাঁকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন সম্ভবত প্রথম বাঙালি লেখক যিনি লেখালিখিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জনপ্রিয় লেখক হয়েও নিজের সাহিত্য থেকে উপার্জিত অর্থে সচ্ছল জীবনযাপন সম্ভব—এ দৃষ্টান্ত তিনিই প্রথম স্থাপন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পান। এছাড়াও, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি পান ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে।
সোমবার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে লেখেন, বাংলা সাহিত্যের চিরস্মরণীয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর জন্মদিবসে তাঁকে জানাই আমার প্রণাম। তাঁর লেখা বিভিন্ন উপন্যাস ও অন্যান্য রচনায়, তিনি সহজ ভাষায় বাঙালি জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, সামাজিক অবিচার ও সংস্কারের চিত্র যে দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার তুলনা সারা বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। তাঁর রচিত ‘শ্রীকান্ত’ ‘পথের দাবী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেবদাস’ সহ অজস্র রচনা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তাঁকে অমর করে রেখেছে। ভারতীয় সাহিত্য ও চলচ্চিত্র তাঁর কাছে চির ঋণী।
এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী জানান বর্তমান রাজ্য সরকার এবং রাজ্য প্রশাসন এভাবে হুগলির দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ভিটে সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট হয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে শরৎচন্দ্রের জন্মস্থানকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। মমতা জানিয়েছেন, আমি গর্বিত, আমাদের রাজ্য সরকার এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটির হাওড়ায় রূপনারায়ণের তীরে দেউলটি-সামতাবেড়ে -পানিত্রাস’র বাসস্থান ও হুগলির দেবানন্দপুরের জন্মভিটা – দুটোরই যথাযথ সংস্কার করেছে ও করছে। হাওড়ার দেউলটিতে, তাঁর ‘হেরিটেজ’ বাড়িটিকে আমরা সাজিয়ে দিয়েছি। এটা দেখতে এখন অসংখ্য মানুষ আসেন। তাঁদের সুবিধার জন্য রাস্তা, আলো, পানীয় জলের ব্যবস্থা সহ সবকিছু করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওখানে আমরা একটি ‘শরৎ স্মৃতি উদ্যান ও ইনফর্মেশন সেন্টার’-ও করছি। হুগলির দেবানন্দপুরে জন্মভিটে সংস্কারের জন্য আমরা ১ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছি, তাড়াতাড়ি কাজ শুরুও হয়ে যাবে। কিছুদিনের মধ্যে দেবানন্দপুরও রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে আরো উঠে আসবে।