হোমারের ইলিয়াড কবিতাটি শত-বছর ধরে মানুষকে মুগ্ধ করেছে। ট্রয় যুদ্ধের কিং হেক্টর, অ্যাকিলিস বা প্রিয়ামের নগরী — সব যেনো এক একরাশ কল্পনা-গল্প। তবে কি হোমার কেবল কল্পনাই ছিল? “Iliad myth or history” — এই বিতর্ক আজও চলছে; ইতিহাস ও পুরাণ মিলিয়ে যা পাওয়া গেছে, তা আশানুরূপ চমৎকার।
হোমার ও ট্রয় যুদ্ধ: পুরাণের পরিধি
ইলিয়াড গ্রিক কবি হোমারের রচিত মহাকাব্য; যুদ্ধের শেষ বছরের কিছু সপ্তাহকে কেন্দ্র করে লেখা। হেক্টর ও অ্যাকিলিসের দ্বন্দ্ব, ট্রয় গোত্রের যুদ্ধ ও ধ্বংস সবই কবিতার পাতায়।
তবে অনেক গ্রিক, রোমান ও পরবর্তী ইতিহাসবিদ ও ভ্রমণকারীগণ ট্রয় নাম শুনেছেন; তার অবস্থান ও নগরীর অস্তিত্ব নিয়ে কিছু কালানুক্রমিক ও ভৌগোলিক বর্ণনা পাওয়া গেছে।
হাইনরিখ শ্লিম্যান: অব্দি থেকে অনুসন্ধান
হাইনরিখ শ্লিম্যান (Heinrich Schliemann), ১৮২২-১৮৯০ সাল, একজন সমৃদ্ধ জার্মান ব্যবসায়ী, যিনি ছোটবেলা থেকেই ইলিয়াড-এর গল্পে মুগ্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন, হয়তো ট্রয় যুদ্ধ কেবল কবিতা নয় — ইতিহাসের এক অংশ।
১৮৭০ এর দশকে তিনি গ্রিস ও তুরস্কে গবেষণা শুরু করেন, বিশেষত Hisarlık নামে একটি মাটির টিলার (tell / ধুলোমাটি-পুরু শহরের স্তূপ) দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পুরাতাত্ত্বিক ফ্রাঙ্ক কালভের্টের পরামর্শও তাকে রাজি হতে সাহায্য করে যে Hisarlık ট্রয়ের সম্ভাব্য স্থান হতে পারে।
ট্রয় খননকাজ ও আবিষ্কারসমূহ
শ্লিম্যান Hisarlık-এ বড় একটি গড়পড়তা খনন শুরু করেন; বহু-স্তর বিশ্লেষণ প্রায় হয়েছিল, কিন্তু সব স্তরই একইভাবে রক্ষিত ছিল না। তিনি “কিল্লার মধ্যে কিল্লা” ধরা মাটির স্তর কাটা শুরু করেন, উপরের স্তরগুলোকে “অনুচিত” ধরে ফেলে বা সময়মত রেকর্ড রাখেনি।
১৮৭৩ সালে তিনি Priam’s Treasure নামে একটি সোনার ও মূল্যবান গহনাগার আবিষ্কার করেন, যা ট্রয় যুদ্ধের প্রিয়াম রাজ্য-গর্ভস্থ কথিত ধন-সম্পদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ধন-সম্পদ প্রায় Troy II স্তরের মধ্যে পাওয়া গেছে যা *ইলিয়াডে বর্ণিত ট্রয়ের সময় থেকে প্রায় ১,০০০ বছর পুরনো।
শ্লিম্যানের পরে উইলহেল্ম ডরফেল্ড (Wilhelm Dörpfeld) কাজ করেন। তিনি বলেছিলেন যে Troy VI বা Troy VIIa স্তরই সবচেয়ে সম্ভাব্য ট্রয় যা কবিতায় বর্ণিত শহরের সঙ্গে মিল থাকতে পারে।
মতবৈচিত্র্য ও বিতর্ক
পদ্ধতির অভাব: শ্লিম্যানের খননকাজে অনেক স্তর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি দ্রুত ফলাফল দেখাতে চান। রেকর্ডিং, নকশা, স্তর বিন্যাস সব কিছুতে বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসরণ হয়নি।
খ্রোনোলজি বোঝাপড়া: যদিও ধন-সম্পদ ও দেয়াল-কাঠামো পাওয়া গেছে, তার বেশিরভাগই আলাদাভাবে কবিতার সময় বলা হয় এমন যুগের আগে বা পরে। তাই ইতিহাস ও পুরাণের সরাসরি মিল সব সময় পাওয়া যায় না।
পুরাতত্ত্বের নতুন গবেষণা: পরবর্তী খননকারী ও গবেষকরা হোমারের বর্ণিত ট্রয়ের সময় ও নির্মাণ ধরণ সংক্রান্ত নতুন তথ্য পেয়েছেন, যেমন গড়-নগরীর পরিধি, দুর্গের মোড়ক, দুশমন আগ্রাসনের চিহ্ন, আগুন ও ধ্বংসের চিহ্ন।
আজকের গ্রহণযোগ্য অবস্থান
আজ বেশিরভাগ পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদরা মেনে নেন ট্রয় নগরীর একটি বাস্তব ইতিহাস রয়েছে — Hisarlık-এ পাওয়া স্তরসমূহে অনেক পুরাতন শহর ও দুর্গাবলী রয়েছে যা অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান দিচ্ছে।
হয়ত ট্রয় যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে কবিতাসৃষ্ট কাহিনি নয়, তবে ইলিয়াডে বর্ণিত কিছু দুর্গা, ধ্বংসের ঘটনা, সামাজিক পরিস্থিতি Bronze Age এ হলেও ঘটেছিল এমন কিছু সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে কবিতায় থাকা ঈশ্বরদের উপস্থাপন, নায়ক-নায়িকার চরিত্র, যুদ্ধের নানান অলঙ্কার — এগুলো পুরাণিক ও সাহিত্যিক উদ্ভাবন, ইতিহাসের সরল চিত্র নয়। Iliad myth or history এই প্রশ্নে দুই-ই কিছু-টুকু সত্য, কিছু-টুকু কল্পনা।
হোমারের ইলিয়াড হয়তো পুরোপুরি ইতিহাস নয়; কিন্তু এটা কেবল এক পুরাণও নয় মাত্র। ইতিহাস ও পুরাণের মিলনে গড়ে উঠেছে একটি সত্যিকারের ন্যারেটিভ, যা আমাদের পুরাতন সভ্যতার প্রতি গভীর আকৃষ্টি সৃষ্টি করেছে। হাইনরিখ শ্লিম্যানের কাজ যদিও সকল দিকেই নিখুঁত ছিল না, তবুও তার উদ্যোগ এবং অনুসন্ধান ইলিয়াড myth or history-বিষয়ক বিতর্ককে শুধু কথায় আটকে রাখেনি, বাস্তব খননের মাধ্যমে ইতিহাসে নামDent করেছে।