সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) ভারতের সেই মহান স্বতন্ত্র সেনানীদের একজন, যাঁরা আজও যুব সমাজের অনুপ্রেরণা। এবং আগামী দিনেও থাকবেন। কেন্দ্র সরকার নেতাজির জন্মদিন পরাক্রম দিবস হিসাবে পালন করার ঘোষণা করেছেন। সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মজয়ন্তী পরাক্রম দিবস হিসাবে পালন করা হবে। ‘তুমি আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব...! জয় হিন্দ!’–এর মতো স্লোগান স্বাধীনতার লড়াইতে নতুন শক্তি জুগিয়েছিল যে নেত সেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এবার ১২৮তম জন্মজয়ন্তী। যদিও আজও এই মহান নেতার মৃত্যু নিয়ে রয়েছে ঘোর রহস্য। আসুন নেতাজিকে নিয়ে জেনে নেওয়া যাক তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িত জানা-অজানা বিশেষ বিষয়।
নেতাজির জন্ম ও মা–বাবার পরিচয়
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ সালে ওড়িশার কটকে হয়েছিল। নেতাজির বাবার নাম ছিল জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবী। জানকীনাথ বসু কটক শহরে প্রসিদ্ধ একজন আইনজীবী ছিলেন। প্রভাবতী দেবী ও জানকীনাথ বসুর মোট ১৪টি সন্তান ছিল। যাদের মধ্যে ৬ জন কন্যা ও ৮ জন পুত্র ছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁদের নবম সন্তান ও পঞ্চম ছেলে ছিলেন।
পড়াশোনা
নেতাজির প্রাথমিক পড়াশোনা কটকের র্যাভেনশা কলেজিয়েট স্কুল থেকে হয়। এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। এরপর নেতাজিকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাঁর মা-বাবা তাঁকে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান।
দেশের জন্য চাকরি ছাড়েন নেতাজি
১৯২০ সালে নেতাজি ইংল্যান্ডে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাস করেন কিন্তু ভারতীয় স্বতন্ত্রতা সংঘর্ষে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সিভিল সার্ভিস ছেড়ে দেওয়ার পরে দেশকে ইংরেজদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। জালিয়ানওয়ালা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নেতাজিকে অত্যন্ত বিচলিত মর্মাহত করে।
নেতাজি–মহাত্মা গান্ধী মতবিরোধ
কংগ্রেসে সেই মহাত্মা গান্ধী উদার দলের নেতৃত্বে ছিলেন, অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন আবেগপ্রবণ বিপ্লবী দলের প্রিয় মানুষ। আর এই কারণের জন্য নেতাজি ও গান্ধীর আদর্শ-বিচার এক ছিল না। নেতাজি গান্ধীজির আদর্শের সঙ্গে সহমত ছিলেন না। যদিও এই দুই নেতা লক্ষ্য একই ছিল যে ভারতকে স্বাধীনতা এনে দিতে হবে। নেতাজি মনে করতেন যে ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়াতে হলে শক্তিশালী বিপ্লবের প্রয়োজন, অন্যদিকে গান্ধী অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন।
কংগ্রেস ত্যাগ করেন নেতাজি
১৯৩৮ সালে নেতাজিকে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের অধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত করা হয়, এরপর নেতাজি রাষ্ট্রীয় যোজনা আয়োগ গঠন করেন। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজির সমর্থনে দাঁড়ানো পট্টাভী সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে জয়ী হন। এর ফলে গান্ধী ও বসুর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়, যার পরে নেতাজি নিজেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
নেতাজির পরিবার
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালে নিজের সেক্রেটারি ও অস্ট্রেলিয়ার যুবতী এমিলির সঙ্গে বিয়ে করেন। এঁদের দু’জনের মেয়ে অনিতা বর্তমানে নিজের পরিবারের সঙ্গে জার্মানিতে থাকেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন
ভারতকে ইংরেজের হাত থেকে মুক্ত করতে নেতাজি ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর ‘আজাদ হিন্দ সরকার’-এর প্রতিষ্ঠা করার সময়ই ‘আজাদ হিন্দ সেনা’ গঠন করেন। এরপর সুভাষচন্দ্র বসু নিজের সেনা নিয়ে ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই বর্মা (এখন মায়ানমার) পৌঁছান। এখানে নেতাজি তাঁর বিখ্যাত স্লোগান ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব’ বলেছিলেন।
অন্যান্য দেশের সহযোগিতা চান নেতাজি
১৯২১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত নেতাজি দেশের স্বাধীনতার জন্য বহুবার জেলে গিয়েছেন। তিনি মানতেন যে অহিংসার জোরে স্বাধীনতা কখনও আসবে না। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, নাৎসি জার্মানি, জাপানের মতো দেশে ভ্রমণ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সহযোগিতা চান।
জার্মানিতে আজাদ হিন্দ ইন্ডিয়া স্টেশন
নেতাজি জার্মানিতে আজাদ হিন্দ ইন্ডিয়া স্টেশন শুরু করেন এবং পূর্ব এশিয়াতে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে ভগবত গীতা তাঁর প্রেরণার মুখ্য উৎস ছিল।
নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য
১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইপেইতে একটি বিমান দুর্ঘটনার পর নেতাজি নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর থেকেই নেতাজির মৃত্যু ও নিখোঁজ নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে। এই ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিশন বসেছিল, যার মধ্যে দুটি তদন্ত কমিশন দাবি করেছিল যে দুর্ঘটনার পর নেতাজি মারা গিয়েছিলেন। বিচারপতি এম কে মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয় তদন্ত কমিশন দাবি করেছিল যে ঘটনার পর নেতাজি জীবিত ছিলেন। নেতাজির এই মৃত্যু বিরোধ বসু পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বিভাজন এনেছিল।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সম্পর্কিত ১০০টি গোপন ফাইলের একটি ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন, যেগুলি দিল্লির জাতীয় আর্কাইভে রয়েছে এবং তা সকলেই গিয়ে দেখতে পারেন।