সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
বিধানসভার অধিবেশন থেকে বিরোধী দলনেতার মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাশ্মীরের জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর যোগ রয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে বলে এদিন মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখবেন তিনি। একইসঙ্গে বললেন, জঙ্গি যোগ প্রমাণ করতে পারলে একদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যাবেন।
এদিন অধিবেশনে নিজের বক্তব্যে মমতা বলেন, “আমাকে বলেছে, আমি নাকি হিন্দুধর্মকে তাচ্ছিল্য করি। আর আমি মুসলিম লিগ করি। এত সংগ্রাম করার পর আমাকে এই জীবনে এসেও শুনতে হবে যে জম্মু ও কাশ্মীরের জঙ্গিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। আর বাংলাদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। বাংলার মানুষকে বলব, যদি প্রমাণ করতে পারেন, একদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।” এরপরই বিরোধী দলনেতাকে আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আপনি মুখের ভাষায়, বিরোধী দলনেতা হিসেবে যে অভিযোগ করেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানাব। একথা আপনি বলতে পারেন কি না। আর যদি আমি জঙ্গি হই, প্রধানমন্ত্রী আমাকে জানাবেন।” বিজেপিকে আক্রমণ করে তিনি আরও বলেন, “এখনও আমরা আছি বলে, বাংলাদেশে এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও বাংলা কিন্তু শান্ত আছে। এটা সর্বধর্মের মানুষের দান। আপনারা সীমান্তে গিয়ে উস্কেছিলেন। কিন্তু, ভুলে যাবেন না, বাংলা দেশের মধ্যে।”
মমতার কথায়, বিজেপি বিধায়করা একটি ধর্মকে বিক্রি করে খাচ্ছেন। কবে থেকে উনি হিন্দু ধর্মের নেতা হলেন। নাম না করে শুভেন্দুকে তোপ মমতার। তিনি আরও বলেন, বিধানসভায় পক্ষে-বিপক্ষে কথা হয়। বিরোধীদের জন্য ৫০ শতাংশ বিধানসভা বরাদ্দ থাকে। অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র করছে বিজেপি। বাইরে প্রচার করা হচ্ছে বিরোধীদের বলতে দেওয়া হয় না। ওদের নাকি বলতে দেওয়া হয় না! আর কত বলবেন?”বিধানসভায় ভাগাভাগি বরদাস্ত করব না।
শুভেন্দু অধিকারী-সহ ৪ বিজেপি বিধায়ককে সাসপেন্ড করার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিধানসভার গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে ধরনায় শুভেন্দু অধিকারী সহ বিজেপির বিধায়করা। তখন বিধানসভার ভিতরে চাঁচাছোলা ভাষায় বিরোধী দলনেতাকে আক্রমণ শানালেন মমতা। বিধানসভায় জবাবি ভাষণে নাম না করে শুভেন্দুকে আক্রমণ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । মমতা বলেন, আমি নাকি হিন্দু ধর্মকে তাছিল্য করে, মুসলিম ধর্মকে লিগ করি। যিনি হিন্দু ধর্মের কথা বলছেন তিনি যানে না আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। এই বয়সে এসে এই সব শুনতে হচ্ছে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে রাজনীতি করিনি। কোনও দিন জাত-ধর্ম নিয়ে কথা বলি না। ভোট এলেই বিবেকানন্দর বাড়ি যায় বিজেপি। বিবেকানন্দর বাড়ি ওরা দখল করে রেখেছে। আমরা ধর্ম বেচে খাই না। আপনারা আবার বড় বড় কথা বলেন কী করে! একটা ধর্মকে বিক্রি করে তো খাচ্ছেন! মনে রাখবেন, আমরা সব ধর্মকে সম্মান করি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি যখন কাগজ ছিড়েছিলাম, তখন আমি একা ছিলাম। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম আমাকে একটা কথা বলতে দিত না। অথচ ৩৯ শতাংশ ভোট ছিল আমাদের। একটা বক্তব্য রাখতে দেওয়া হত না। একটা প্রশ্নও করতে দেওয়া হত না। বাধ্য হয়েই ওটা করতে হয়েছিল।”এখন তো তেমন পরিস্থিতি নেই। আমরা তো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সবাইকে বলতে দেওয়া হয়। কিন্তু শুধুই বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা হলে কী বা বলা যেতে পারে!”
বিধানসভায় দাঁড়িয়ে একের পর এক ইস্যুতে বিজেপিকে চাঁচাছোলা আক্রমণ শানান মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “মহাকুম্ভ এখন মৃত্যুকুম্ভ হয়ে গিয়েছে। কুম্ভকে সম্মান করি, কিন্তু প্ল্যানিং না করে এত হাইপ। বড়লোকেদের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার ক্যাম্প করা হয়েছে। আর গরিবদের জন্য শুধুই টাকার খেলা। ভিভিআইপিদের স্নানের জায়গা আলাদা। আর গরিবদের জন্য আলাদা জায়গা।”
মহাকুম্ভের সঠিক পরিকল্পনা না করেই যোগীর সরকার কুম্ভস্থলকে কলুষিত করেছে বলে তোপ দাগেন মমতা। তিনি বলেন, “গরিবরা এক কাপ লাল চা খেলেও ৫০০ টাকা। মাদুর পেতে বসলেও টাকা নেওয়া হচ্ছে। বললেন ৩০ জন মারা গিয়েছে। কত দেহ জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। হাজার হাজার দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সব জায়গায় হাইপ তুলে দিয়েছে। এত হাইপ তুলতে নেই এই সব বড় প্রোগ্রামে।”
যদিও মহাকুমকো নিয়ে মমতার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করে বিরোধী দলনেতা বলেন, “এখনও পর্যন্ত মহাকুম্ভে ৪০ কোটি মানুষ গিয়েছেন। সবাই আশা করছেন, আরও ১০ কোটি মানুষ যাবে। সেখানে আপনি মহাকুম্ভকে মৃত্যুকুম্ভ বলেছেন। আপনি বলেছেন কুম্ভমেলা টাকা রোজগারের জন্য করা হয়েছে। এতবড় অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এই মন্তব্যের খেসারত আপনাকে দিতে হবে। মহাকুম্ভের অপমান হিন্দুস্তান সহ্য করবে না। হিন্দুস্তান আপনাকে গণতান্ত্রিকভাবে সবক শেখাবে। মহাকুম্ভকে অপমান করার জন্য যেখানেই সুযোগ পাবেন, মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পোড়ান। প্রয়াগরাজের সব আখড়াকে অনুরোধ করব, এই অপমানের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।”
গত ১৪ জানুয়ারি প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা শুরু হয়েছে। দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থীরা ভিড় করছেন মহাকুম্ভে। উত্তর প্রদেশ প্রশাসনের অনুমান, ৪৫ দিনের এই মহাকুম্ভে ৪০-৪৫ কোটির মতো পুণ্যার্থী পা রাখতে পারেন মহাকুম্ভে। সেইমতো ধরলে গড়ে প্রতিদিন এক কোটি পুণ্যার্থী যাচ্ছেন মহাকুম্ভে। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, ভিড় নিয়ন্ত্রণে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিবাসীদের প্রত্যর্পণ নিয়ে বলেন, ‘আমরাও তো প্রশ্ন করতে পারি, যারা এল, তাঁদের শিকল বেঁধে নিয়ে আসা হল কেন? কী উত্তর আপনাদের? বলে দিচ্ছেন ওটা ওদের প্রোটোকল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে সম্মান জানিয়ে বলছি, আপনি যেদিন প্রেসেন্ট ছিলেন সেদিনও কিন্তু তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছে এভাবে।.. মানবিকতা তো সবার মধ্যে.. কিন্তু আপনি কি একবারও প্রতিবাদ করেছিলেন?’ উল্লেখ্য, সদ্য মোদীর মার্কিন সফরের সময় দ্বিতীয় দফায় আমেরিকা থেকে ভারতীয় অভিবাসীদের প্রত্যর্পণ করা হয়। সেই প্রসঙ্গ তুলে বিধানসভায় প্রশ্নবাণ তাক করেন মমতা। এরই সঙ্গে মমতা বলেন,’ আজ যদি আপনারা দায়িত্ব নিতেন, তাহলে তাঁরা সম্মানের সঙ্গে ফিরতে পারত। সেই দায়িত্ব আপনারা নেননি। পায়ে শিকল বেঁধে, হাতে শিকল বেঁধে ৪০ ঘণ্টা ঘুরিয়ে.. শিশু থেকে মহিলা কেউ বাদ যাননি, তা সত্ত্বেও আমরা তো কিছু বলিনি। আজ বলছি, কারণ আপনারা বাধ্য করছেন বলবার জন্য।’.. তিনি বলেন,’দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত করতে চাই না। তাই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেন্দ্র যা করবে তাই মেনে নেব। বাংলা তাতেই ভালো থাকে।’
দীঘায় জগন্নাথধাম নিয়ে শুভেন্দুকে নিশানা মমতার। মমতা বলেন, “দীঘায় জগন্নাথধাম হোক, বকবক বাবু কি বলেছিলেন, তার মানে আপনি চান না। খুব জ্বালা হচ্ছে, কচুরিপানায় গিয়ে বসে থাকুন। বুকের পাটা থাকলে আটকাবেন। মমতা ব্যানার্জির ভয় টয় নেই।” শবেবরাতের ছুটি নিয়ে বিজেপির খোঁচার পাল্টা খোঁচা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “শবেবরাত নয়। পঞ্চানন বর্মার জন্মদিবসের ছুটি ছিল। পঞ্চানন বর্মার অসম্মান করে রাজবংশীদের ভোট চাইতে যাবেন না।”
হিন্দুত্ব নিয়ে পাল্টা বিজেপিকে আক্রমণে মমতার আরও বক্তব্য, “দিল্লির নেতারা এসে বলেন বাংলায় দুর্গাপুজো করতে দেয় না। তথাকথিত হিন্দু যারা, তারাপীঠ মন্দির ঘুরে দেখেছেন? রাত্রিবেলায় স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি যখন দখল হচ্ছিল, তখন কোথায় ছিলেন? ভোটের সময় আপনারা বিবেকানন্দের বাড়ি যান। দার্জিলিংয়ে সিস্টার নিবেদিতা যে বাড়িতে প্রয়াত হয়েছিলেন, তা বিমল গুরুং দখল করেছিলেন।”
এরপর নানা প্রসিদ্ধ মন্দিরের নাম তুলে ধরেন মমতা। বলেন, “ভবতারিণী মন্দির, তারাপীঠ মন্দির, কঙ্কালীতলা সতীপীঠ, ফুল্লরা মায়ের মন্দির, তারকনাথের মন্দির, মদনমোহন মন্দিরে উন্নয়ন কারা করেছে? কালীঘাটের মন্দিরে স্কাইওয়াক কারা করছে? আমাদের সরকার। গঙ্গাসাগরের ব্রিজ করে দেওয়ার জন্য বলতে বলতে মুখ ব্যথা হয়ে গিয়েছে। বিজেপির হিন্দু পথপ্রদর্শকরা, আপনারা বলেছিলেন? আমরা করেছি।”
সাসপেনশন ইস্যুতে বিধানসভার বাইরে শুভেন্দুদের ধরনা প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “আদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও সংসদে বৈঠকে থাকে তৃণমূল। বাইরে বলা হচ্ছে, বিরোধীদের বলতে দেওয়া হয় না। এখানে ৫০ শতাংশ সময় দেওয়া হয় বিরোধীদের। তা সত্ত্বেও কুৎসা অপপ্রচার বাংলার। আমি যখন কাগজ ছিঁড়ে ছুড়়েছিলাম, তখন আমি একা ছিলাম। ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়েও আমি তখন একা ছিলাম।”
মুখ্যমন্ত্রী যে কলেজে আইন পড়েছেন, সেই যোগেশচন্দ্র ল কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধাদানের অভিযোগ উঠেছে। এদিন এই নিয়েও মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “ব্যাপারটা কী ছিল, জানতে হবে। সেখানেও পুজো হয়েছে। আমি যোগমায়া দেবী কলেজের ছাত্রী ছিলাম। যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর ল কলেজে পড়তাম। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী ছিলাম না। যেহেতু ওখানে একটা নির্মাণের কাজ চলছে। ওখানে নোংরা পড়েছিল। সেজন্য বলেছিল, গেটের সামনে নয়, একটু সরিয়ে নাও। ওরা গেটের ভিতরে করতে চেয়েছিল। পরে আদালতে যায়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দুটো পুজোই হয়। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ ও ল কলেজে দুটো জায়গাতেই পুজো হয়েছে।” যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ ও ল কলেজে সরস্বতী পুজোর দুটি ছবিও অধিবেশন কক্ষে তুলে ধরেন তিনি। বলেন, “আমি এভিডেন্স দিয়ে প্রমাণ করে দিলাম।” রেকর্ডের জন্য সেই দুটো ছবি স্পিকারের কাছে জমাও দেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “আমি কখনও আমার ধর্ম নিয়ে কথা বলি না। কাস্ট নিয়ে কথা বলি না। কমিউনিটি নিয়ে কথা বলি না। আমার একটা কবিতা আছে, পদবিটা না থাকলেই ভাল হত। আর যিনি হিন্দুধর্মের কথা বলছেন, জেনে রাখুন আমিও কিন্তু, ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। আমার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলাম। তাঁর কাছ থেকে চণ্ডীপাঠ শেখা।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “আপনি কথায় কথায় পিতৃদেবের কথা তোলেন। বলেন, সব কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবার সম্পত্তি? আমার বাবার অনেক দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল। নিজের সম্পত্তি ছিল। আমরা এসব নিইনি।”