সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
বিতর্কিত ওয়াকফ আইন (WAQF Act) নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের আবহে বিষয়টি পৌঁছেছে সুপ্রিম কোর্টে। এই আইনের বিরুদ্ধে জমা পড়া একাধিক আবেদনের শুনানি হল বুধবার প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের তিন সদস্যের বেঞ্চে। শুনানির সময় কেন্দ্রের উদ্দেশে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেন প্রধান বিচারপতি খান্না।
এদিন শীর্ষ আদালত অন্তর্বর্তী রায় দেওয়ার কথা ভাবলেও, কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আরও একদিন সময় চাওয়া হয়। ফলে আগামীকাল ফের এই মামলার শুনানি হবে এবং সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার বক্তব্য শোনা হবে। তবে তার আগে এদিন আদালত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাব দেয়।
শুনানি চলাকালীন ওয়াকফ আইন নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তোলে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি ওয়াকফ বোর্ডের (WAQF Board) ২২ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৮ জন মুসলিম কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার কার্যত বাগযুদ্ধ বাধে। তুষার মেহতা এই যুক্তির ভিত্তিতে শীর্ষ আদালতের বেঞ্চে মামলার শুনানি হওয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন।
এর পাল্টা প্রধান বিচারপতি খান্না স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমরা যখন বিচারপতির আসনে বসি, আমাদের ধর্ম থাকে না। সব পক্ষই আমাদের কাছে সমান’। এখানেই না থেমে তিনি আরও প্রশ্ন করেন, ‘তার মানে কী বলতে চাইছেন, হিন্দুদের দাতব্য ট্রাস্টের বোর্ডে মুসলিমদের স্থান হবে? প্রকাশ্যে বলুন’। প্রধান বিচারপতির এই প্রশ্নে আইনি মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
এদিনের শুনানিতে বাংলার মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক অশান্তির প্রসঙ্গও উঠে আসে। প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলা বিচারাধীন থাকাকালীন এই ধরনের হিংসা কাম্য নয়। একইসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, ‘২৬ নম্বর ধারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। সব সম্প্রদায়ের জন্য এটা প্রযোজ্য’।
ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫-এর সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একাধিক মামলা হয় শীর্ষ আদালতে। এই মামলার শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের কাছ জানতে চায়, আপনারা কি হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মন্দির কমিটিতে মুসলিমদের অংশ নিতে দেবেন? তৃণমূল কংগ্রেস এমপি মহুয়া মৈত্র সহ ভারতের বিভিন্ন কোণা থেকে আদালতে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপি শাসিত হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগড় এবং অসম এই আইনকে সমর্থন করেছে আদালতে।
প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এদিন তিনটি অন্তর্বর্তী নির্দেশের প্রসঙ্গ তোলেন। যার প্রথমটি হল, আদালত ঘোষিত ওয়াকফ সম্পত্তি অবিধিবদ্ধ বা ওয়াকফের নয় বলা যাবে না, তা সে ব্যবহারকারীর হোক বা না হোক। দ্বিতীয়টি হল, কালেক্টর বা জেলাশাসক ওয়াকফ নিয়ে বিবাদ নিষ্পত্তি করতে পারলেও সেটা এখনই হচ্ছে না। বোর্ড ও কাউন্সিল যাই হোক সেখানে এক্স অফিসিও সদস্য নিয়োগ করা গেলেও অন্য সদস্যদের মুসলিম হতে হবে।
প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিনের শুনানির শেষে জানিয়েছেন, তারা একটি অন্তর্বর্তী রায় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন যেখানে কয়েকটি বিষয় নিয়ে তারা মতামত দেবেন।
প্রথমত, যে সম্পত্তিগুলোকে আদালত ওয়াকফ বলে ঘোষণা করেছে, সেগুলোকে ‘ডিনোটিফাই’ করা যাবে কি না, বা ‘নন-ওয়াকফ’ হিসেবে ঘোষণা করা যাবে কি না। আর এটা ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বা সেরকম নয়, দু’ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
দ্বিতীয়ত, কালেক্টর (জেলা শাসক) এই ধরনের কেসে তার তদন্ত বা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা যাবে কি না।
তৃতীয়ত, ওয়াকফ বোর্ড ও কাউন্সিলগুলোতে ‘এক্স অফিশিও’ (পদাধিকারবলে) যারা নিযুক্ত হন তাদের কথা আলাদা (যেমন এমপি, এমএলএ, জেলাশাসক প্রভৃতি) – কিন্তু বাদবাকি সদস্যদের মুসলিম হতেই হবে কি না।
উল্লেখ্য, ওয়াকফ আইন সারা দেশ জুড়ে কার্যকর হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে। বাংলাতেও এই নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা অশান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই ওয়াকফ ইস্যু সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে এবং আগামীকাল ফের শীর্ষ আদালতে এর শুনানি রয়েছে। সকলের নজর এখন সেই শুনানির দিকে।
ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তিরও দলিল চাই?
ভারতে ওয়াকফ বাই ইউজার সেই ধরনের ধর্মীয় বা দাতব্য সম্পত্তিকেই বলে যা মুসলিমরা হয়তো শত শত বছর ধরে ব্যবহার করে আসছেন, কিন্তু সেগুলোর মালিকানার কোনো প্রামাণ্য নথি নেই। এগুলো মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা বা কবরস্থান- এ ধরনের অনেক কিছুই হতে পারে।
এক্ষেত্রে সম্পত্তির ‘দীর্ঘকালীন ব্যবহার’কেই ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃতির ভিত্তি হিসেবে এতকাল ধরা হয়ে এসেছে।

এদিন সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে আবেদনকারীদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী কপিল সিব্বাল বলেন, “ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো এই ওয়াকফ বাই ইউজার!”
“এখন সমস্যা হলো, যে সম্পত্তি হয়তো তিন হাজার বছর আগে ওয়াকফ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সরকার এখন সেটারও ডিড (দলিল) দাবি করছেন!”
অপর একজন পিটিশনারের তরফে সিনিয়র আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি তখন বলেন, ভারতে যে প্রায় আট লাখের মতো ওয়াকফ সম্পত্তি আছে, তার মধ্যে চার লাখই কিন্তু ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’।
এই পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না বলেন, “আমরা শুনেছি দিল্লি হাইকোর্ট ভবনই নাকি ওয়াকফ জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।”
“আমরা এটা বলছি না যে সব ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’-ই ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্যিকার উদ্বেগের কারণ আছে”, মন্তব্য করেন তিনি।
অভিষেক মনু সিংভি তখন বলেন, তারা নতুন ওয়াকফ আইনের কয়েকটি বিশেষ ধারার ওপর স্থগিতাদেশ চাইছেন, পুরো আইনটির ওপর নয়।
কেন্দ্রের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা যুক্তি দেন, এই আইনটি পাস হওয়ার আগে তা নিয়ে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই সুবিশদ ও সুদীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে। একটি যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটি এই বিলটি সবিস্তারে পর্যালোচনা করেছে এবং তাদের ছাড়পত্র মেলার পরই তা সভায় পেশ করা হয়েছে।