সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
সনাতন ধর্মানুযায়ী দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যার এই ক্ষণটির গুরুত্ব অনেক। শ্রী শ্রী চণ্ডিতে মহালয় হচ্ছে পুজো বা উৎসবের আলয় (আশ্রয়)। চণ্ডিতে ‘মহালয়’ বলতে ‘পিতৃলোক’কেই বোঝানো হয়। তর্পণের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করা হয়। হিন্দু ধর্মানুসারে কোনও শুভ কাজের আগে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার প্রথা রয়েছে।
এই তপর্ণের সঙ্গে কেবল শাস্ত্র নয়, পুরাণেরও যোগ রয়েছে। ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে কর্ণ সম্বন্ধীয় যে কাহিনি পাওয়া যায়, সেখানে বলা হয়েছে কর্ণ দান ধ্যান করলেও তা ছিল স্বর্ণ, রত্ন, মণিমাণিক্য। পিতৃপুরুষের পরিচয় না জানার জন্য পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে কখনো জল বা খাদ্য দান করেননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যুর পর স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয় শুধুই সোনা-রত্ন। জীবিত অবস্থায় যা দান করেছেন তারই একটি অংশ। কর্ণকে দেবরাজ ইন্দ্র জানান যে পিতৃপুরুষকে কখনো জল দেননি তাই মৃত্যুর পরে কর্ণ জল পানে অক্ষম। এই ভুলের জন্য এক পক্ষকালে মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিয়ে পাপস্খলন করেন কর্ণ। সেই একপক্ষ কালকেই পিতৃপক্ষ বলা হয়। শাস্ত্রমতে এই এক পক্ষ কাল ধরেই পিতৃপুরুষকে অন্নজল দেওয়া যায়।
আবার শ্রী শ্রী চণ্ডীতে তপর্ণকে রাজা সুরথের কাহিনি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সুশাসক সুরথ যবন জাতির কাছে পরাজিত হয়ে মনের দুঃখে বনে গিয়ে দেখা পান মেধা ঋষির। সেখানে তিনি শোনেন মহাময়ার গল্প (যা শ্রীশ্রীচণ্ডী-র মূল আলোচ্য বিষয়)। এরপর মহালয়ার দিনে তর্পণ করে সমাধি নদীর তীরে তিন বছর কঠিন তপস্যা করে দুর্গাপুজো শুরু করেন। আবার এই পিতৃতর্পণের সঙ্গে রামায়ণের রামচন্দ্রের কাহিনিও পাওয়া যায়।
তবে তর্পণ যে কেবল পূর্বপুরুষদের জন্য তা নয়, পৃথিবীর সামগ্রিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে, উত্তোরণের উদ্দেশে। সেই কারণেই তর্পণ মন্ত্রে বলা হয়ে থাকে, “তৃপ্যন্তু সর্বমানবা”। অর্থাৎ মানবজাতিকে তৃপ্ত করার দিন। এই তর্পণ শব্দের ব্যুৎপত্তি হল তৃপ + অনট। তৃপ ধাতুর অর্থ তৃপ্তি সাধন করা। এখানে তৃপ্তি সাধন বলতে দেব-ঋষি- পিতৃ-মনুষ্যগণের তৃপ্তিসাধনকে করার অর্থে ব্যবহার করা হয়। মহালয়ের এই লগ্নে যাঁদের পুত্র নেই, যাঁদের কেউ নেই, তাঁদেরও স্মরণ করা হয়ে থাকে তর্পণের মাধ্যমে। তাই মন্ত্রে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ। তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ। অর্থাৎ, যাঁরা আমাদের বন্ধু ছিলেন, যাঁরা বন্ধু নন, যাঁরা জন্ম-জন্মান্তরে আমাদের বন্ধু ছিলেন, যাঁরা আমাদের কাছে জলের প্রতাশা করেন, তাঁরা সম্পূর্ণরূপে তৃপ্তিলাভ করুন।
হিন্দুশাস্ত্রে নানারকম তর্পণের কথা বলা হয়েছে, যেমন, দেব তর্পণ, গুরু তর্পণ, মনুষ্য তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্যপিতৃ তর্পণ, যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, পিতৃ তর্পণ, মাতৃ তর্পণ, অগ্নিদগ্ধাদি তর্পণ, রাম তর্পণ ও লক্ষণ তর্পণ। পিতৃপক্ষের শেষ লগ্নে তর্পণ করা হয় এই মন্ত্রের সঙ্গে- “পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ।”
শাস্ত্রবিশেষজ্ঞরা জানান যে পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আলোকজ্জ্বল দেবীপক্ষকে আগমন করি, তাই সেই মহা লগ্ন আমাদের জীবনে ‘মহালয়া’। তর্পণের শেষে তাই সূর্যপ্রণাম করে অসুরবিনাশিনী দেবীকে আহ্বান করে বলা হয়- “সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে/ শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে।” শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকার কাটিয়ে আলোকে উত্তরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে চলার ক্ষণই সেই মহালয়।