সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“বি অ্যালার্ট। বাইরে থেকে কোনও জঙ্গি যেন কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে।” বাইরে থেকে আসা কোনও জঙ্গি যেন বাংলায় আশ্রয় নিতে না পারে – ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনার আবহে বুধবার উত্তরকন্যায় প্রশাসনিক বৈঠকে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে সতর্ক করে একথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তরকন্যার বৈঠক থেকে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেন তিনি।
পাশাপাশি পুলিশকে তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পুলিশের ভ্যান নিয়ে যত বেশি ঘোরা যাবে, মানুষ তো জানবে যে এরা অ্যালার্ট আছে। বর্ডায় এরিয়া খুব সংবেদনশীল।”
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার আবহে দেশের বিভিন্ন রাজ্যকে আগেই সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। এই পরিস্থিতিতে এদিন উত্তরকন্যার বৈঠক থেকে পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলার প্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন তিনি। পুলিশকে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি শুনছি অনেক বাইরের লোক, কেউ অসম থেকে.. কেউ এদিক থেকে, কেউ ওদিক থেকে …বিভিন্ন লোক বিভিন্ন এলাকায় ঢুকছে। ঢুকে, এমনকী আমাদের সমর্থকের কাছ থেকেও তার নম্বর, তার প্যান-আধার নম্বর-ফোন নম্বর, সে কী করে তার ডিটেলস নিয়ে চলে যাচ্ছে। অফিসারদেরও। আমি পুলিশকে বলব, বি অ্যালার্ট। বাইরে থেকে কোনও জঙ্গি যেন কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে। তেমনি যারা মানুষকে মিথ্যা কথা বলে মানুষের জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এটা মনে রাখবেন…অথরাইজড লোক ছাড়া …বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি। কেউ কাউকে কোনও ডিটেলস দেবেন না। এরকম অনেককে ধরা হয়েছে। ঝাড়গ্রামে একটা টিম ধরা পড়েছে। মালদা, কোচবিহার, কলকাতা, ডায়মন্ডহারবার অনেক জায়গায়। ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ বিজ্ঞানের যুগে মানুষ যত এগিয়ে চলছে, তেমনি আবার অনেক ক্ষতিকারক শক্তি বেড়েছে। যেটা মানুষ আগে ভয় পেত না। সুতরাং চোখ-কান খোলা রেখে সবাই কাজ করুন। একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রত্যেককে লক্ষ্য রাখতে হবে।”
এরপর পুলিশের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা, “আগে পুলিশরা ৫-৬ বার এলাকায় গিয়ে ঘুরত। এখন ঘোরেই না। পুলিশের ভ্যান নিয়ে যত বেশি ঘোরা যাবে, মানুষ তো জানবে যে এরা অ্যালার্ট আছে। বর্ডার এরিয়া খুব সংবেদনশীল। এই তো কিছুদিন আগে শীতলকুচি থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। একটা চাষি বেচারা। তাঁর নিজের জমি। তিনি চাষ করেন। কোনো দোষ ছিল না। তারপর খবরটা উদয়ন আমাকে বলার পরেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা অ্যাকশন নিয়ে তাঁকে বেল করিয়ে আমরা নিয়ে এসেছি। এরকম বিভিন্ন পরিকল্পনা চলছে। বর্ডায় এরিয়াটা ভীষণ সেনসিটিভ। লক্ষ্য রাখবেন। বিএসএফ-এর দায়িত্ব আছে বলে, আপনারা ওসি-রা চোখ-কান বুঝে বসে রইলেন, সেটা হয় না।”
পুলিশমন্ত্রীর অভিযোগ, আগের মতো আর সক্রিয় নয় পুলিশ। পুলিশকে তাঁদের দায়িত্ব মনে করিয়ে মমতা বলেন, ”বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে মানুষ যেমন এগিয়ে চলছে, তেমন ক্ষতিকর শক্তিও বাড়ছে। যা আগে ছিল না। তাই সকলকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আগে পুলিশ তিন-চার বার এলাকায় এলাকায় ঘুরত। এখন ঘোরেই না!” তাঁর সংযোজন, ”যত বেশি পুলিশ ভ্যান নিয়ে ঘুরবে মানুষ তো জানবে যে পুলিশ অ্যালার্ট আছে।”
উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকা স্পর্শকাতর বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। সেই সমস্ত জায়গায় বিশেষ নজরদারি রাখার নির্দেশ দিয়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ”বিএসএফ দায়িত্বে আছে বলে নিজেরা বসে থাকবেন না। এইতো কয়েক দিন আগে শীতলখুচি থেকে এক জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। উদয়ন গুহ আমাকে জানানোর পর তাঁকে জামিন করিয়ে ছাড়িয়ে এনেছি আমরা। তাই ‘বিএসএফের দায়িত্বে আছে’ বলে নিজেরা বসে থাকবেন না। পাড়ার ক্লাবগুলো হাতে রাখুন। এটা পুলিশকে বলছি।”
বন্যার প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ”পশ্চিমবঙ্গ নৌকার মতো। সিকিমে বর্ষা হলে উত্তরবঙ্গ ডোবে। ঝাড়খণ্ডে হলে দক্ষিণবঙ্গ ডুবে যায়। ভুটানের বাঁধগুলো থেকে জল ছাড়া হলেও বন্যা হয়ে যায়।” এরপরেই কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ”অসম টাকা পায়। আমরা কিন্তু পাই না। বেশি কথা বললে তিক্ততা বাড়বে। আর তিক্ততার কথা বলতে চাই না। সিকিম, ভুটানে ইতিমধ্যে বন্যা হচ্ছে। সতর্ক থাকুন। মানুষের পাশে থাকতে হবে। বর্ষাকালীন কাজের প্রস্তুতি নিন।”

পুরসভা নিয়ে ক্ষোভ মুখ্যমন্ত্রীর
রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিভিন্ন পুরসভা আলাদা করে কর চাপাচ্ছে বলে অভিযোগ করে মমতা বলেন, “পুরসভা ইচ্ছা মতো ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। এটা করা যাবে না। এটা কি বাঁশের থেকে কঞ্চি বড়? দুবার ট্যাক্স নেওয়া যাবে না। কোচবিহারে এসডিপিও চন্দনবাবু বলে কেউ আছেন? তিনি মিটিংয়ে আসেনি কেন? হেডকোয়ার্টার দেখে তাকে কাজ দাও না। তাকে কাজ করতে দাও না। নিজেরাই যদি গ্রুপ তৈরি করো কী হবে? ওঁকে দিনহাটা-শীতলকুচিতে কাজে লাগাও। হেড কোয়ার্টারে একজনকে বসিয়ে রাখবে সে শুধু চা-বিস্কুট খাবে চলে যাবে? সে কাজ চায় তুমি কাজ করতে দেবে না। পুলিশ নিজের মধ্যে গ্রুপ করে? করে না। আমরা রাজনীতির লোকজন বেশি গ্রুপ করি। আমরা তাই জেনে এসেছি। আমি জানি কোনও কোনও সংবাদপত্র এটা নিয়ে ন্যারাটিভ করবেন সেটা করবেন না। যাঁরা করছেন তাঁদের অনেক কিডন্যাপিং কেস জানি।”
গ্রামে বেআইনি নির্মাণ
শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম অঞ্চলেও বেআইনি নির্মাণের ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে গোটা রাজ্যে। সেই প্রসঙ্গে রাজ্য প্রশাসনকে সতর্ক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পঞ্চায়েতের বাড়িগুলো করতে দেদার অনুমতি দিচ্ছেন। এগুলো কিন্তু ফলো করতে হবে। শহরে গাইডলাইন মেনে চললেও পঞ্চায়েত মানছে না কেন? হোটেল-বাড়ি-শপিং মল হলে আপত্তি নেই। কিন্তু সুরক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে। পাইপ ফেললে জল পৌঁছনোর দায়িত্ব কিন্তু আপনার। মাটি পরীক্ষা না করেই কেন পাইপ ফেলেন? পিএইচই ডিপার্টমেন্টকে বলব এগুলো দেখব। মালদহের প্রকল্প কেন পড়ে থাকে? এর মধ্যে বেশি হল পিএইচই।”
ভেজাল ওষুধ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, “সিএমওএইচ জানেন? অনেক ওষুধ ব্যান করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা এই ওষুধ ব্যবহার না করেন। গুজরাট ও ইউপি থেকে ভেজাল ওষুধ আসছে। বড় বড় সাইনবোর্ড লিখুন। কুটি-কুটি করে লিখলে হবে না। অনেকেই ফর্ম ফিলাপ করতে পারেন না। তাদের সাহায্য করুন।চা বাগানের সমস্যা হচ্ছে। নেপালের চা সস্তায় চলে আসেছে। কারণ ট্যাক্স দিতে হয় না ওদের। তাহলে আমরা কেন দেব? ওরা বাজে চা ঢুকিয়ে দার্জিলিং চায়ে মেশাচ্ছে আর সব নষ্ট।
ফেক নিউজ থেকে সাবধান হোন
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ইদানিং কিছু মিডিয়ার একাংশ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কেউ-কেউ প্রতি মুহূর্তে ফেক নিউজ এবং উত্তেজনা ছড়ানোর খবর ছাড়ছে। অনেক সময় ভাবি যা বেরাচ্ছে সব সত্য। ডিএম-বিডিওদের অনুরোধ করছি সকলে মাথায় রাখবেন ফেক ধরবার মেশিনারি আছে। আজকের দিনে ফেক বিক্রি টাকা ইনকামের পথ হয়েছে। অনেক সময় রাজস্থানের ছবি-বাংলাদেশের ছবি বাংলার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগে ডিজিটালে দেখছি হুমকি দেওয়ার খবর লিখছে। এটা লেখা উচিত ছিল না। উত্তেজনা বাড়বে। বর্ডারে অশান্তি বাড়বে। আর এতে সমস্যা বাড়বে সাধারণ মানুষের। শান্তি বজায় রাখা সকলের দায়িত্ব।”