সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“কেন পহেলগাঁও হামলায় অভিযুক্ত একজন জঙ্গিকেও ধরা গেল না? পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক যে সংঘর্ষ হল সেই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এমনকী অধিকৃত কাশ্মীর দখলেরও সুযোগ ছিল। সেটাও বাস্তবায়িত করা গেল না।” এভাবেই মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় পহেলগাঁও জঙ্গি হানা ও তার পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যের জন্য সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন প্রস্তাবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন রাজ্য বিধানসভায় অপারেশন সিঁদুর-এর সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বীরত্ব ও শৌর্যকে কুর্নিশ জানিয়ে বিশেষ সভা বসে। যদিও সেখানে সেনাবাহিনীর রাখা নাম অপারেশন সিঁদুর উল্লেখিত ছিল না, হয়ওনি। যা নিয়ে বিজেপি তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছে। রাজ্য বিজেপি প্রশ্ন করেছে কেন সিঁদুর নামটি বিধানসভায় রেজোলিউশন থেকে বাদ দেওয়া হল? বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, পহেলগাঁও হামলায় বেছে বেছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে টার্গেট করা হয়েছে। অথচ বিধানসভার রেজোলিউশনে তার উল্লেখ নেই।
এর জবাবে মমতা বলেন, “সন্ত্রাসের কোনও বর্ণ, জাত, ধর্ম হয় না। আমরা তা সমর্থন করি না। বিজেপিকে পাল্টা আক্রমণ করে মমতা বলেন, কেন্দ্র ভারতের জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, ওরা বিদায় নিক। কেন্দ্রের উদাসীন মনোভাবের কারণেই পহেলগাঁওয়ে হামলা হয়েছে। কেন সেখানে নিরাপত্তারক্ষীরা ছিলেন না?”
মমতার বক্তব্যের এই পর্যায়ে শুভেন্দু অধিকারী উঠে দাঁড়ান। বলেন, এসব কী হচ্ছে? যদিও মুখ্যমন্ত্রী তাতে থামেননি। তিনি বলতে থাকেন, “গোটা ঘটনা কানেক্টেড। যারা হামলা করল কেন ধরা গেল না? জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিএসএফ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা এজেন্সিগুলিকে আরও পোক্ত করা উচিত।” এর পরেই শুভেন্দু অধিকারীর উদ্দেশে সরাসরি আক্রমণ হানেন, “আপনাকে দেখেই বোঝা যায়, আপনি কিছু জানেনই না। আপনার মত লিমিটলেস অপোজিশন লিডার জীবনেও দেখিনি। অপদার্থ বিজেপি। দেশের লজ্জা। আপনি বিরোধী দলনেতা? লজ্জা। সামান্য ভদ্রতা জানে না।”
ফের পহেলগাম প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলতে থাকেন, “টোটাল সিকিউরিটি ফেলিওর। কেন আপনাদের কাছে খবর ছিল না? সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। সরকারের কাছে কেন ছিল না ইনটেলিজেন্স ইনপুট, বিশেষ করে পুলওয়ামায় অত বড় কাণ্ডের পরে?” এর পরে ফের শুভেন্দুদের চিৎকার-প্রতিবাদ চলতে থাকে। তালি বাজিয়ে বাজিয়ে স্লোগান ওঠে, মোদী, মোদী! এই পরিস্থিতিতে চেয়ারে দাঁড়িয়ে শুভেন্দুদের বসতে বলেন স্পিকার।
অধিবেশনে মঙ্গলবার বক্তব্য রাখতে উঠে এবার জম্মু ও কাশ্মীরে পহেলগাঁও হানা থেকে পুলওয়ামায় জঙ্গি হানার ঘটনা নিয়ে সরব হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিনের বক্তব্যে বিধানসভায় পারদ চড়িয়ে গেরুয়া শিবিরের দিকে তোপ দাগেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভায় তখন চলছিল ‘মোদী মোদী’ স্লোগান। তারই মধ্যে বলতে থাকেন মমতা। সেখানে দেখা যায় বিরোধী শিবির থেকে শুভেন্দু অধিকারীরা যখন সরব, তখন তারই মাঝে মমতা বলতে থাকেন, “ভোট এলেই ‘পুলওয়ামা’ যেন করতে না হয়!” এদিন মমতার ভাষণে উঠে আসে পহেলগাঁও প্রসঙ্গ। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “জঙ্গিরা কী ভাবে ঢুকল? বিএসএফ, সিআইএসএফ কী করছিল? তারা কতদিন থেকে ছিল, কোথা থেকে এলো, মেরে দিয়ে চলে গেল… একজনকেও ধরা গেল না কেন?” একই সঙ্গে তাঁর বার্তা, “এই সময়ই তো সুযোগ ছিল পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করার। কেন করা হল না?”
তিনি বলেন, “আমি জন্মভূমিকে শ্রদ্ধা জানাই। কিছু মানুষ দেশকে ভালবাসে। কেউ কেউ নিজের ‘মার্কেটিং’ করতে ভালবাসেন।” মমতা এদিন সেনাদের সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানিয়ে বলেন, “বাংলা প্রথম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের ধন্যবাদ জানাই।” জঙ্গি নিধন অভিযান ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা, “কেন্দ্র সরকারের আরও স্ট্রং হওয়া উচিত ছিল।” এদিন জয়শংকর প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “বিদেশমন্ত্রী ভালো মানুষ। একজন দক্ষ আমলা ছিলেন।” তবে একইসঙ্গে মমতার প্রশ্ন, “রাষ্ট্রসঙ্ঘে সন্ত্রাসবাদ কমিটির চেয়ারম্যান পেয়েছে পাকিস্তান। কী ভাবে? আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে কি খামতি ছিল?”
পহেলগাঁওতে জঙ্গি হামলায় ভারতীয় পর্যটকের মৃত্যু আর তার পাল্টা ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাঘাতমূলক অভিযান- তার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একটি প্রস্তাব আনে বিধানসভার সচিবালয়। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই প্রস্তাব আনা হয়। এই প্রস্তাবের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বক্তব্য রাখতে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পহেলগাঁও হত্যালীলার তীব্র নিন্দা করেন। আর প্রত্যাঘাত হিসাবে ভারতীয় সেনা যে পদক্ষেপ করেছেন, তা কৃতিত্ব স্বীকার করেন। পহেলগাঁওয়ের সহিস আদিল, যিনি পর্যটকদের রক্ষা করতে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হন, তাঁকেও কুর্নিশ জানান মমতা।
মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের মাঝেই বাধা দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাতেই মেজাজ হারিয়ে সুর সপ্তমে চড়ান মমতা। খানিকটা উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, “আপনাকে দেখে মনে হয় কিছু জানেন না। আমি প্রশ্ন করব। কারণ, দেশের নীতির প্রশ্ন। কাল যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন দেখবেন আপনাদের চেপে ধরেছে। পুলওয়ামার (ঘটনার) পর রাজ্যপাল কথা বলেছিলেন। আমরা সিঁদুরকে সম্মান করি। আপনি মহিলাদের সম্মান করেন না। সিঁদুর নিয়ে প্রচার করে বেড়ান। যেখানে হামলা হয়েছে, কেন প্রধানমন্ত্রী যাননি? শুধু বাজার করে বেড়াচ্ছে! আপনি নিজে লড়াই করেননি। আমাদের ঘরের ছেলেদের লড়াই করতে গিয়েছে।” বিজেপিকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বিজেপি হল দেশের সর্বনাশ। দেশের পক্ষে লজ্জা বিজেপি। কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। ওই ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইস্তফা দেওয়া উচিত ছিল। দেশের মানুষকে নিরাপত্তা না দিতে পারার জন্য পদত্যাগ করা উচিত। পদত্যাগ না করে শুধু রাজনীতি করেন। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে রাজ্যের বাসিন্দা সেই গুজরাত থেকে তথ্য গিয়েছিল। কী ভাবে গুজরাত থেকে পাকিস্তানে তথ্য পাচার হল?”

হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি না করতে বিজেপি বিধায়কদের অনুরোধ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাকে হিন্দুত্ব শেখাবেন না। আপনারা নকল, ছদ্মবেশী হিন্দু ধর্ম করে বেড়াচ্ছেন। আমি রামকৃষ্ণ, গান্ধিজির হিন্দু ধর্ম মানি। আপনাদের মতো ‘ফেক’ ধর্ম নয়।”