সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নেতাজিকে নিয়ে সেরা ২০ ছবির অ্যালবাম
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শুধু একটা নাম নন, তিনি আজও ভারতের মানুষের অন্তরাত্মা। তাঁর দর্শন, স্বাধীন ভারতকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর করে যাওয়া পরিকল্পনা সকলকে পথ দেখিয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের বুকে জন্ম নিয়েছেন একের পর এক বীর ব্যক্তি। এঁদের সকলেরই সম্মিলিত মিশ্রণ যেন ছিলেন নেতাজি। এঁদের সকলের ভাবনা, পরিকল্পনা, স্বাধীন ভারতের উন্নয়ন- সমস্তকিছুকে নিজের দর্শনের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবের বারুদেও আগুন লাগিয়েছিলেন তিনি। কারণ, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে। নচেৎ শান্তিপ্রিয় ভারতবাসীকে কোনওভাবেই স্বাধীন হতে দেবে না ব্রিটিশরা। কিন্তু স্বাধীনতা আনলেই তো হবে না, দেশে ও দশের উন্নয়ন, স্বাধীন ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়ভার কীভাবে কার্যকর হবে? সে পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন। যা স্বাধীনতার পরবর্তীভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নামে পরিচিত ছিল। নেতাজি ফিরে আসেননি, কিন্তু তাঁর তৈরি করে যাওয়া উন্নয়নের দর্শনকেই গ্রহণ করেছিল জওহরলাল নেহরু-র সরকার।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এমন এক সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন যখন অধিকাংশ জাতীয় নেতাদের মনে ভারতের শিল্পায়নের বিষয়টা মাথায় এসে ছিল। প্রশ্ন উঠেছিল ভারতে শিল্পায়ন কী রূপ নেবে। কেউ কেউ কুটির শিল্পের উপর জোর দেওয়ার পক্ষে এবং অন্যরা শিল্পোন্নত পশ্চিমের শক্তির দিকে তাকিয়ে বৃহৎ আকারের শিল্পায়নের পক্ষে ছিলেন ৷
1938 সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সভাপতির ভাষণে স্বাধীন ভারতের জন্য যে নীলনকশা তুলে ধরেছিলেন , তাতে ধারণা দেওয়া হয়েছিল – স্বাধীন ভারত সরকারের প্রথম কাজ হবে একটি ‘ জাতীয় প্লানিং কমিশন ‘ গঠন করা। এরপরে নেতাজি 1938 সালের 2 অক্টোবর,দিল্লিতে রাজ্যের শিল্প মন্ত্রীদের সম্মেলনে দেওয়া প্রদত্ত ভাষণে তার জাতীয় পরিকল্পনার ধারণার রূপরেখা তুলে ধরেন। এইভাবে নেতাজি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠনের দিকে এগিয়ে যান, যা তিনি 1938 সালে 17 ডিসেম্বর বোম্বেতে উদ্বোধন করেছিলেন।
1938 সালের 21শে অগস্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে নেতাজি জাতীয় পুনর্গঠনের সমস্যাগুলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘আমাদের যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা হল শিল্প পুনরুদ্ধার নয় , বরং শিল্পায়ন ৷ ভারত এখনও রয়েছে প্রাক-শিল্প পর্যায়ে।যতক্ষণ না আমরা একটি শিল্প বিপ্লবের পথ অতিক্রম করি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো শিল্প অগ্রগতি সম্ভব নয় ।… প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে যে এই বিপ্লব, অর্থাৎ শিল্পায়ন , গ্রেট ব্রিটেনের মতোই ধীরে ধীরে হবে , নাকি সোভিয়েত রাশিয়ায় মতো সজোরে আসবে ৷’
হরিপুরা অধিবেশন এবং পরবর্তীকালে 1938 সালের জুলাই মাসে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর , এটিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিশাল সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে , তিনি সরকারি ফোরাম ব্যবহার করে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তৎকালীন এই উপমহাদেশ ব্রিটিশ ভারত এবং ভারতীয় শাসিত রাজ্যে বিভক্ত ছিল। জাতীয় পরিকল্পনার ধারণার কথা বলার সময় , নেতাজি মনে মনে নিশ্চিত ছিলেন যে পরিকল্পনা প্রক্রিয়াটি ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত প্রদেশের পাশাপাশি সমস্ত ভারতীয় রাজ্যকেও এর আওতায় আনতে হবে।তিনি যখন কংগ্রেস শাসিত সাতটি প্রদেশের সরকারের কাছে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন , তখন একই সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেস শাসিত নয় এমন ব্রিটিশ ভারতীয় রাজ্যগুলিকে এবং ভারতীয় রাজাদের শাসিত রাজ্যগুলিকেও এই পরিকল্পনা আওতায় আনা এবং যাতে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একত্রীত করে ভারতের পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করা যায়।
নেতাজি যুগের আবির্ভাবের আগে , কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি শুধুমাত্র একটি শিল্প পরিকল্পনার কথা বলেছিল , নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় পরিকল্পনার ধারণায় দ্রুত শিল্পায়নের প্রয়োজনের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও বেকারত্ব , জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয় পুনর্গঠনের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন । .
জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির প্রথম সভার স্থান হিসাবে মুম্বাইকে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ বোম্বে প্রদেশের তৎকালীন সরকার এই ঐতিহাসিক কমিটির কার্যকারিতার জন্য পরিকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করবে বলে আশা করা হয়েছিল ৷ জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির প্রথম বৈঠকটি নেতাজি উদ্বোধন করেন এবং সভাপতিত্ব করেন জওহরলাল নেহরু । ওই সময় নেতাজি জওহরলাল নেহরুকে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। 1938 সালের 19 অক্টোবর একটি চিঠিতে জওহরলাল নেহরুকে সভাপতিত্বের প্রস্তাব দিয়ে নেতাজি লিখেছিলেন , ‘আমি আশা করি আপনি পরিকল্পনা কমিটির সভাপতিত্ব গ্রহণ করবেন। এটিকে সফল করতে হলে আপনাকে অবশ্যই থাকতে হবে।’
কংগ্রেস সভাপতি এবং জাতীয় পরিকল্পনার ঐতিহাসিক ঘটনাটির স্থপতি হিসেবে নেতাজি নিজে প্রথম চেয়ারম্যান হতেই পারতেন। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য ঐক্যমত্য হওয়াটা আবশ্যক। ইতিহাসের যে সময়ে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটা জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র আদর্শগত দ্বন্দ্ব দ্বারা চিহ্নিত ছিল। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং ভারতে পরিকল্পনা ও শিল্পায়নের বীজ উর্বর জমিতে বপন করার জন্য , নেতাজি প্রথম জাতীয় পরিকল্পনা কমিটিতে নিজেকে শীর্ষে বসাতে চাননি যদিও ওই কমিটি গঠন প্রাথমিকভাবে সম্ভব হয়েছিল কারণ কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে তাঁর গৃহীত প্রচেষ্টার দ্বারা।
নেতাজি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতে সরকার গঠিত হলে পরিকল্পনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে। এই লক্ষ্য অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রাক্কালে, 1946 সালের অক্টোবরে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক জাতীয় পর্যায়ে একটি উপদেষ্টা পরিকল্পনা বোর্ড গঠন করা হয়, যার ফলে 1952 সালে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে 2014 সালে মোদী সরকার পরিকল্পনা কমিশন তুলে দেন এবং বদলে নীতি আয়োগ গঠন করা হয়৷