প্রিয়াঙ্কা মান্না। কলকাতা সারাদিন।
বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুর্গোৎসব। এই পুজোকে ঘিরে রয়েছে বাঙালির আবেগ। পুজো ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। বর্তমানে থিমপুজোর চল বাড়লেও একসময় পুজো বলতে ছিল বনেদি বাড়ির পুজো। কলকাতা শহরে বহু যুগ আগে শুরু হয়েছিল দেবীর আরাধনা। এক অন্য স্বাদের সাবেকি রীতি রেওয়াজে পুজিত হতেন মা। তবে, বর্তমানে যে সেই রীতির নিষ্পত্তি ঘটেছে এমন নয়। এখনও কলকাতা শহরেও একাধিক বনেদি বাড়িতে বিশেষ নিয়ম মেনে মায়ের পুজো করা হয়।
দক্ষিণ কলকাতায় বেশ খ্যাত সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গোৎসব। ১৭ শতকের সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা এই তিনটি গ্রাম অধিগ্রবণ করেছিল ইংরেজরা। সেই সময় ইংরেজ শাসন থাকাকালীন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে দুর্গোপুজোর প্রচল হয়। এই পরিবারের সদস্যরা যে অঞ্চলে বাস করতেন সেখান পুজো করতেন। তবে, এদের বিখ্যাত পুজো হল আটচালা পুজো। যা ১৬১০ সালে শুরু হয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার বড়িশাতে এখনও এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
বেহালা তথা কলকাতার সব থেকে পুরনো দুর্গাপুজো বললেই যে পুজোর কথা মাথায় আসে সেটা হল সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। ৯৭৫ সালে আদিশূর ছিলেন এই বাংলার শাসক। বাংলায় যাতে বিন্দু ধর্ম স্বমহিমায় বজায় থাকে তার জন্য তিনি কনৌজ থেকে ৫ জন ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেদগর্ভ, যাঁকে এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আদিপুরুষ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে।
কলকাতার ইতিহাসের শিকড়ে এই পরিবারের অবস্থান। আর কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস ঘাঁটলেও একেবারে প্রথম পর্বেই উঠে আসবে এই পরিবারের নাম।
বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোই কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপুজো হিসেবে মানেন অনেকে।
সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির পুজো মোট ৮টি বাড়িতে হয়। তার মধ্যে আছে, আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, বেনাকি বাড়ি , মেজো বাড়ির পুজো, কালীকিঙ্কর ভবনের পুজো, মাঝের বাড়ি পুজো। এছাড়াও বিরাটি বাড়ি ও নিমতা বাড়িতে পুজো হয়ে আসছে।
বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী রীতি-নিয়ম মেনে এখানে পূজিত হন দশপ্রহরধারিণী। পুজো হয় এক চালচিত্রে।
একই চালচিত্রের মধ্যে থাকে তিন ভাগ। মাঝে থাকেন সপরিবার মা দুর্গা। দুই পাশে থাকেন মহাদেব ও রামচন্দ্র। এটাই সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির প্রতিমা গড়ার রীতি।
সুপ্রাচীন কাঠামোতেই নতুন করে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়া হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর কাঠামো তুলে নেওয়া হয় জল থেকে।
সন্ধিপুজোর একটি বিশেষত্ব রয়েছে। সদ্যস্নাতা পরিবারের সদস্যা ভিজে গায়ে, ভিজ কাপড়ে ভোগ রান্না করেন। মায়ের ভোগে থাকে ল্যাটা বা শোল মাছ। মাছ পুড়িয়ে মাখন মিশিয়ে নিবেদন করা হয় দেবীমূর্তির সামনে।
সপ্তমী থেকে দশমী ১৮ টি ভাগে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় মা দুর্গাকে। মুখে কাপড় বেঁধে রান্না করতে হয় ভোগ। এই পুজোর বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত পুকুরেই হয়ে থাকে।
পুজোর শেষে বাড়িতে তৈরি বোঁদে দিয়েই হয় দশমী পালন। দিন গড়িয়েছে, বছর গড়িয়েছে, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্যময় অতীত এখন লোকের মুখে মুখে ফেরে।