সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
“আমাদের মনে পাথর নেই। লাল-হলুদ-সবুজ দেখার দরকার নেই। আমাকে জেলে ভরে দিলেও আমি ডোন্ট কেয়ার। মানুষ যখন সমস্যায় পড়ে তখন তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়। আমি কেস স্টাডি করে দেখেছি। যারা যোগ্য বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।” এভাবেই আজ নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে যোগ্য চাকরিহারাদের আশ্বাস দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুপ্রিম কোর্টের কলমের খোঁচায় প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। আজ, সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে সেই সমস্যার সমাধান করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতি যে হয়েছে, চাকরি যে বিক্রি হয়েছে সেটা তাঁর অজানা বলে ভরা সভায় জানিয়ে দিলেন। আইনজীবীদের প্যানেল তৈরি করলেন। সেটাও সকলকে জানালেন। আর যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন তাঁদের একটা প্রতিনিধিদলকে যোগাযোগ রাখতে বললেন। জীবন থাকতে চাকরি কারও যেতে দেবেন না বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই চাকরি বিক্রি হওয়া থেকে শুরু করে নিয়োগ দুর্নীতি তাঁর আড়ালেই হয়েছে বলে বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্টে আবার রাজ্য সরকার যাবে চাকরিহারাদের জন্যও সেটাও আজ ভরা সভা থেকে বাতলে দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “চাকরি বিক্রি হয়েছে, চাকরি চুরি হয়েছে আমি জানিই না। তাও আমাকে খারাপ কথা শুনতে হচ্ছে। কাজ করতে গেলে একটা দুটো ভুল হয়েই যায়। একটা কলমের খোঁচায় জীবনটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছে।”
বাংলাকে বঞ্চিত করার জন্য একটা চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে চক্রান্ত করা হচ্ছে। সবাইকে অযোগ্য বলার অধিকার কে দিয়েছে। বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে যেন না কাঁদে। আমি জেনেশুনে কারও চাকরি খাইনি। সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য অযোগ্য বাছাই করে দেয়নি। রাজ্য সরকারকেও বাছতে দেয়নি। অভিষেক মনু সিংভি, কপিল সিবাল, রাকেশ দ্বিবেদী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত ভূষণ এই পাঁচজন আইনজীবীকে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হচ্ছে ক্লারিফিকেশন চাওয়ার জন্য। আমরা ক্লারিফিকেশন চাইব আদালতের কাছে। আজকে শিক্ষকরা কি করবে? স্কুল কে চালাবে? আমার পাঁচটি পথ ভাবা আছে। সুপ্রিম কোর্ট যা বলবে সেই ভাবেই কাজ হবে।”
এদিনের সভা থেকেও সিপিএম-বিজেপিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে বিকল্প পথও ভাবা আছে বলে আশ্বস্ত করেন চাকরিহারাদের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “চাকরি দেবার ক্ষমতা নেই। চাকরি খাবার কাজ যারা করেছে তাদের আমি ঘৃণা করি। আমরা সিবিআইকে বাছতে বলেছিলাম। কেউ ভুল করলে তার দায় আমরা নেব না। বলছে ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয় হলে চাকরি করে দেব। আমার সরকার চাকরি দিয়েছিল। কাড়লেন কেন? ত্রিপুরায় ১০ হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছিল। ইস্তেহারে বিজেপি বলেছিল ক্ষমতায় এলে চাকরি করে দেবে। সেসব দেয়নি। উলটে প্রতিবাদ করলে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আমি সারাদিন গালাগাল খাব আর বলতে পারব না তা কি হয়। একজন প্রধান বিচারপতির রায়কে আর একজন বিচারপতি বাতিল করে দিলেন। মুখ আর মুখোশদের দোষ এসবের পিছনে। যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি কেড়ে নিতে দেব না। এটা আমার কমিটমেন্ট।”
সিপিএমের ৩৪ বছরে বহু দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তিনি কারো চাকরি ছাঁটাই করেননি বলে দাবি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রথমে সিঙ্গল বেঞ্চে, প্রথমে অভিজিতবাবুর বেঞ্চে, একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির লিস্ট বাতিল করা হয়। তারপর ডিভিশন বেঞ্চে, সবটাই করা হয়। সিবিআইকে কেস দেওয়া হয়। সিবিআইকে সাহায্য করি, বলি বাছুন, কে যোগ্য, কে অযোগ্য। বলছে ছাব্বিশের ভোটের পর চাকরি করে দেব, আগে একটা কথা আমি আপনাদের বলি, তারপর আমি কী করতে পারি, সেটা আপনাদের বলব। কয়েক দিন ধরে আমাকে… যে মানুষটা জানে না কী হয়েছে, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি… আমি আমার জীবনে জেনেশুনে কারোর চাকরি খাইনি, অনেক বদহজম হওয়া সত্ত্বেও সিপিএমের একটা চাকরিও খাইনি। সিপিএম ৩৪ বছর অনেক অন্যায় করে গিয়েছে। কারণ আমি বলেছিলাম, বদল চাই, বদলা নই। তুমি গিয়ে কেন অ্যাপ্লাই করলে? বিকাশভট্টাচার্যকে প্রশ্ন মমতার। কেন সমস্ত তালিকা বাতিল করেছে? আজকে বাইরে আমার নামে বড় বড় কথা বলছো। আমি তো চাকরিগুলো দিয়েছিলাম। আমার সরকার দিয়েছিল। এক দুটো কাজ করতে গেলে ভুল হতেই পারে। সেই ভুল সংশোধনের জন্য প্রশাসনকে সময় দাও। তা তো দাওনি। রাইট টু মেক ব্লান্ডার্স! নেতাজি বলেছিলেন, ভুল করাও অধিকার। যদি কারোর ভুল হয়ে থাকে, সংশোধন করার দায়িত্ব কার? কোর্ট যদি প্রশাসনকে সেই দায়িত্ব দিত, প্রশাসন নিশ্চয়ই সেই কাজটা করতে পারত।”
যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাঁচাতে তাঁর বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি বলেও দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ মমতা বলেন, “আমার প্ল্যান এ, বি, সি সব তৈরি৷ আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, ভরসা রাখুন৷ মাথার উপরে আমরা আছি, কারও প্রতি কোনও অবিচার হবে না৷ এটা আমি কথা দিয়ে গেলাম৷”
একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছেন, সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা দেয়নি৷ রাজ্য সরকারকেও সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে দাবি মুখ্যমন্ত্রীর৷ সিবিআই-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আদালত রায় দিয়েছে বলেই দাবি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ রায়ের আরও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়ে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানাবে বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ততদিন পর্যন্ত চাকরিহারা শিক্ষকদের স্কুলে গিয়ে স্বেচ্ছায় পড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
মমতা বলেন, “আগে যোগ্যদেরটা ঠিক করতে দিন। আস্থা রাখুন। অযোগ্যদের নথিপত্র দেখব। সেটা নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে আগে যোগ্যদেরটা দেখব। চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে থাকুন। যোগ্য-অযোগ্যদের গন্ডগোল লাগাবেন না। বাচ্চাদের শিক্ষা দিন। আমি নিশ্চয় সকলের কথা শুনব। আগে আমাকে তদন্ত করতে দিন। আপনি ক্ল্যারিফিকেশন চাইব। আইনের ধারা অনুযায়ী কাজ করব। কারও চাকরি যাক চাই না। আপনাদের কারও কাছে ভিক্ষা করে খেতে হবে না। পড়াশোনা করুন। বাচ্চাদের মানুষ করুন। ভলান্টিয়ারি সার্ভিস দিন। আমরা চাই আইন আপনাদের সুরাহা করুন। মমতাকে খাস্তা করতে গিয়ে শিক্ষকদের চাকরি কেড়ে নেবেন না। কারও উসকানি, প্ররোচনা শুনে প্ররোচিত হবেন না। মনে রাখবেন।”