রাহুল সিংহ মজুমদার। কলকাতা সারাদিন।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি, দেশবিরোধী কার্যকলাপ এবং সংবেদনশীল তথ্য পাচারের অভিযোগে ভারতের জনপ্রিয় ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রাকে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশ। এই ঘটনার তদন্তে নেমে হরিয়ানা এবং পাঞ্জাব সহ একাধিক রাজ্যে ছড়ানো একটি বড় গুপ্তচর নেটওয়ার্কের পর্দাফাঁস হয়েছে।
এই মামলায় জ্যোতি সহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত ইউটিউবারের নাম জ্যোতি মালহোত্রা। তিনি ‘ট্র্যাভেল উইথ জো’ নামে একটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল চালান এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ২০২৩ সালে যখন তিনি কমিশনের মাধ্যমে ভিসা নিয়ে পাকিস্তান সফরে যান, তখন তিনি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্টদের সংস্পর্শে আসেন।
পাকিস্তান সফরের সময় জ্যোতি মালহোত্রার সঙ্গে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মচারী এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশের পরিচয় হয়। জানা গেছে, তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দানিশের মাধ্যমেই জ্যোতি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-র অন্যান্য এজেন্ট, যেমন আলি আহসান এবং শাকির ওরফে রানা শাহবাজের (যার নাম তিনি তাঁর ফোনে ‘জট রানধাওয়া’ হিসেবে সেভ করেছিলেন) সঙ্গে পরিচিত হন।
তদন্তে জানা গেছে, জ্যোতি মালহোত্রা হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে এই পাকিস্তানি এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় পাকিস্তানের পক্ষে ইতিবাচক ভাবমূর্তি পোস্ট করতেন না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীল তথ্যও শেয়ার করছিলেন। তদন্তে আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে যে, জ্যোতির একজন পাকিস্তানি গোয়েন্দা এজেন্টের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং সম্প্রতি তিনি সেই এজেন্টের সঙ্গেই ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান জ্যোতির সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবকে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচার এবং গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করছিল।
এই গুরুতর বিষয়টি সামনে আসার পর ভারত সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গত ১৩ মে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মচারী দানিশকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ (persona non grata) ঘোষণা করে দ্রুত ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, জ্যোতি মালহোত্রার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির (BNS) ধারা ১৫২ এবং ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধারা ৩, ৪ এবং ৫ এর অধীনে মামলা রুজু করা হয়েছে। পুলিশ জ্যোতির লিখিত স্বীকারোক্তিও রেকর্ড করেছে। এই মামলার তদন্ত এখন হিসারের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এই মামলাটি কেবল ইউটিউবার জ্যোতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি একটি বড় গুপ্তচর নেটওয়ার্কের উন্মোচন করেছে। এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার অনেক জেলার মানুষ জড়িত। এই মামলায় জ্যোতি সহ এখনও পর্যন্ত মোট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া অন্যান্য অভিযুক্তরা হয় সরাসরি পাকিস্তানি এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত অথবা তাদের জন্য আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত, নয়তো সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করত।

গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন পাঞ্জাবের মালেরকোটলার ৩২ বছর বয়সের ঘাজালা, যিনি দানিশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে জড়িত ছিলেন এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতেন। এছাড়াও, ইয়ামিন মহম্মদ নামে আরেক অভিযুক্ত দানিশকে হাওলা এবং অন্যান্য মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে সাহায্য করতেন। হরিয়ানার কৈথল থেকে দেবিন্দর সিং ধিলনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যিনি পাকিস্তান সফরের সময় পাতিয়ালা ক্যান্টনমেন্টের ভিডিও তুলে পাকিস্তানি এজেন্টদের কাছে পাঠিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। হরিয়ানার নুহ থেকে আরমান নামে এক স্থানীয় মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যে পাকিস্তানি এজেন্টদের নির্দেশে ভারতীয় সিম কার্ড সরবরাহ করেছিল এবং ডিফেন্স এক্সপো ২০২৫-এর স্থান পরিদর্শন করেছিল বলে জানা গেছে।
এই ঘটনা ভারতের নিরাপত্তা পরিকাঠামো এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চালানো গুপ্তচরবৃত্তির ঝুঁকিকে সামনে এনেছে। এই গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সম্পূর্ণ উন্মোচনের জন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলি কাজ করে চলেছে।