রেজাউল ইসলাম। কলকাতা সারাদিন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরে এক ব্যক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্য। অভিযোগ, সামান্য বিবাদের জেরে এক ব্যবসায়ীকে বেধড়ক মারধর করা হয়, এবং সেই মারধরের জেরেই মৃত্যু হয় তাঁর। মৃতের নাম রঞ্জিত মণ্ডল (৩৫)। এই ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেসের এক পঞ্চায়েত সদস্যসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। পুলিশ ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত সদস্য নারায়ণ রায়কে গ্রেপ্তার করেছে।
কীভাবে ঘটল ঘটনা?
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাতে সোনারপুর ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের শীতলা অঞ্চলে একটি ব্যবসায়ীর সাইকেল নেওয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বিবাদ। বিবাদের সময় উপস্থিত ছিলেন পঞ্চায়েত সদস্য নারায়ণ রায়। অভিযোগ, তিনিও পরিস্থিতি সামলানোর বদলে উল্টে ওই মারধরে অংশ নেন।
রঞ্জিত মণ্ডলকে তখনই বেধড়ক প্রহার করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে সুভাষগ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে, পরে চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি — হাসপাতালে পৌঁছনোর কিছু পরেই তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পুলিশের তদন্ত
ঘটনার পর মৃতের পরিবার সোনারপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। তদন্তে নেমে পুলিশ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে — যার মধ্যে একজন হলেন স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য নারায়ণ রায়। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাকি তিনজন অভিযুক্ত পলাতক। পুলিশ সূত্রে খবর, তাদের ধরতে একাধিক স্থানে তল্লাশি চলছে। ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু প্রমাণও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বারুইপুর পুলিশ জেলার এক পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, “ঘটনাটি নৃশংস। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে এটি গণপিটুনি বলেই মনে হচ্ছে।”
এ বিষয়ে বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রূপান্তর সেনগুপ্ত জানান, এই ঘটনার ভিত্তিতে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ অভিযুক্তকে জেরা চলছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে এলাকায় তল্লাশি শুরু করা হয়েছে।
রাজনৈতিক চাপানউতোর
ঘটনাটি সামনে আসতেই রাজনীতির মঞ্চে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। সিপিএম নেতা ও আইনজীবী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা। শাসক দলের স্থানীয় নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। তাদের ছত্রছায়ায় এই ধরণের অপরাধ বাড়ছে।” সিপিএম নেতা তথা আইনজীবী সায়ন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের অভিযোগ, পঞ্চায়েত সদস্য ও বিধায়কের ছত্রছায়াতেই এমন ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে, তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, আইন নিজের পথে চলবে, কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে রেয়াত করা হবে না। গণপিটুনির এই ঘটনা ফের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক দায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে । তিনি বলেন, “সোনারপুরের বিধায়কের ছত্রছায়াতেই পঞ্চায়েত সদস্যদের এমন বাড়বাড়ন্ত। গণপিটুনিতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য জড়িত, এটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। গণপিটুনিতে তৃণমূলের একজনের পিছনে জড়িত নন। আরও অনেকে জড়িত। পুলিশকে সক্রিয় হতে হবে।”
অন্যদিকে, তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, “আমরা আইনকে সম্মান করি। দোষ প্রমাণিত হলে কাউকে রেয়াত করা হবে না। এটি একটি ব্যক্তিগত বিবাদ, বিরোধীরা রাজনৈতিক রঙ লাগানোর চেষ্টা করছে।” সোনারপুর 2 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রবীন সর্দার বলেন, “বিষয়টি আমি শুনেছি। একটা মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। পরে একজন মারা যান। আমাদের এক পঞ্চায়েত সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। আইন নিজের পথে চলবে। প্রশাসন বিষয়টি দেখছে।”
ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শীতলা এলাকায় মোতায়েন হয়েছে। রাতভর চলছে টহলদারি। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকেই এলাকায় দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাড়ছে, আর তারই বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনারপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত শীতলা এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “এখানে ছোটখাটো ঝামেলা হলেই মারধর শুরু হয়ে যায়। পুলিশের কড়া নজরদারি প্রয়োজন।”
আইনি প্রেক্ষাপট ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ
পুলিশ জানিয়েছে, সোনারপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ধৃত তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে খুন, আঘাত এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।
মৃতদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আরও ধারায় মামলা যুক্ত হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে পুলিশ।
রাজ্য প্রশাসনের তরফে জেলা পুলিশকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, তার জন্য নজরদারি বাড়াতে।

ঘটনার সারমর্ম
মৃত: রঞ্জিত মণ্ডল (৩৫), স্থানীয় ব্যবসায়ী
ধৃত: নারায়ণ রায়, Sonarpur 2 Gram panchayat তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য
মোট অভিযুক্ত: ৪ জন
মামলা: গণপিটুনিতে মৃত্যু, খুনের অভিযোগে মামলা রুজু
বর্তমান অবস্থা: এক জন গ্রেপ্তার, তিন জন পলাতক
এলাকা: শীতলা, সোনারপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত
এই ঘটনা ফের প্রশ্ন তুলেছে — গ্রামীণ রাজনীতিতে ক্ষমতার ব্যবহার ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা কতটা স্বচ্ছ?
মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতে, গণপিটুনি এখন ভয়ঙ্কর সামাজিক প্রবণতায় পরিণত হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত ও কঠোর শাস্তিই এই প্রবণতা রোধের একমাত্র উপায়।