ডা: মো: হাফিজুর রহমান (পান্না), রাজশাহী, বাংলাদেশ।
গত ৫ আগস্ট শৈর শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর রাজশাহী সাবেক মেয়র ও এমপিরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। জানা যায় সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও রাজশাহীর ছয়টি সংসদীয় আসনের সাবেক আট সংসদ সদস্যে (এমপি) অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে একাধিক সংস্থা। এসব সম্পদ ফেলে সপরিবারে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র ও এমপিরা।
জানা যায়, রাজশাহী সিটির সাবেক মেয়র ও বাকি ছয় আসনের সাবেক সাতজন এমপি পলাতক থাকায় তাঁদের সম্পদ দেখাশোনা করছেন আত্মীয়-স্বজন বা নিজেদের বিশ্বস্ত লোকজন। এসব সম্পদ থেকে এর মধ্যে কিছু লুটও হয়েছে।
মেয়র লিটন পরিবারের সম্পদ বেড়েছে এক হাজার কোটি টাকা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন বিকেল থেকে সপরিবারে পলাতক রয়েছেন রাজশাহীর সাবেক সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। রেখে গেছেন অন্তত এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। সরকার পতনের দিন দুর্বৃত্তরা ৫ আগস্ট রাতেই লিটনের বাড়িতে লুট শেষে আগুন দেয়। এ সময় নগর ভবনেও আগুন দেওয়া হয়। একাধিক সূত্রের দাবি, নগর ভবনে মেয়রের গোপন কক্ষে ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। বাড়িতে ছিল অন্তত ১০ কোটি টাকা, সোনার গয়না, ডলারসহ দামি আসবাব পত্র লুট হয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, সব মিলিয়ে গত ১৬ বছরে লিটন পরিবারের অন্তত এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা হাসেম আলী বলেন, ‘২০০৮ সালের আগে লিটনের সম্পদ বলতে তাঁর বাবার রেখে যাওয়া কিছু জমিজমা আর দুটি বাড়ি। এখন তো তিনিসহ পরিবারের সদস্যদের রয়েছে অগাধ সম্পত্তি। সবই পড়ে আছে। বাড়ির ইটও খুলে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষ।’
ফারুক চৌধুরীর মালয়েশিয়ায় বাড়ি ও ব্যবসা
রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীও সপরিবারে পলাতক রয়েছেন। তিনি গত প্রায় ১৬ বছরে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য ও প্রকল্প বাণিজ্য করে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ।
একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, মালয়েশিয়ায় ফারুক চৌধুরীর বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছবিও দিয়েছেন সামাজিক যোগাগোযোগ ফেসবুকে। অথচ ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় ফারুক চৌধুরী হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তাঁর ব্যাংকে কোনো টাকা ছিল না। চলতি বছর নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় তিনি ব্যাংকে জমা দেখিয়েছেন ৯ কোটি টাকা।
গোদাগাড়ীর আবু বাক্কার ও তানোরের শফিকুল ইসলাম নামের আওয়ামী লীগ কর্মী অভিযোগ করেন, ‘ফারুক চৌধুরী এলাকায় নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম থেকে শত শত কোটি টাকা আয় করেছেন। শুনেছি, তিনি মালয়েশিয়ায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন।’
রাজশাহী (সদর ২) শতকোটি টাকার সম্পদ ফজলে হোসেন বাদশার
বিগত প্রায় ১৬ বছরে নৌকা প্রতীকে তিনবার এমপি হয়ে শতকোটি টাকার সম্পদ গড়লেও এখনো রাজশাহীতে অবস্থান করছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। জানা যায়, বিএনপি নেতাদের ম্যানেজ করে তিনি রাজশাহীতে অবস্থান করছেন। ফজলে হোসেন বাদশা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে এই দলের সঙ্গে যুক্ত তিনি। কিন্তু গত চারবার সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে।
অভিযোগ রয়েছে, গত তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি সরকারি প্রকল্প আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম থেকে অন্তত শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রাজশাহীর কোর্ট এলাকায় তাঁর এক সময়ের ছোট বাড়িটি এখন ৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৯ তলা বাড়ি।
রাজশাহীর হড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘বাদশা গত ৫ আগস্টের পর কয়েক দিন পলাতক ছিলেন। এখন দেখছি এলাকায় ঘুরছেন। মাঝেমধ্যে একে-ওকে বলছেন, তিনি নাকি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে রফাদফা করছেন। তাই তিনি জোর গলায় বলেন তাঁর নামে কোনো মামলা হয়নি, আর হবেও না।’
আসাদ-আয়েন পলাতক
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সদ্য সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান আসাদ এবং তার আগের দুইবারের এমপি আয়েন উদ্দিন পলাতক। আসাদের এই কয়েক দিনের সম্পদের তেমন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর পাঁচ ভাই এই কয় মাসেই নিয়োগ বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য, হাট-ঘাট দখলের বদৌলতে অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সর্বশেষ পবার খড়খড়ি হাট লিজ দেওয়ার নামে এক দিনে ৩৫ লাখ টাকা হতিয়ে নিয়েছেন তাঁর এক ভাইএমনটি দাবি করেন পবা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এমদাদুল হক।
সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন গত ১০ বছরে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর পূর্বাচলে তাঁর তিন কাঠা জমি, স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট, রাজশাহী মহানগরীর উপশহরে রয়েছে আরও একটি ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে আয়েনের।
সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায় ব্যাস্ত ছিলেন বাগমারার দুই সাবেক এমপি
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের আমলে দুই এমপি ছিলেন এনামুল হক ও আবুল কালাম আজাদ। তাঁরা দুজন গত ১৬ বছর ধরেই পরস্পরের বিরোধী ছিলেন। আবার দুজন সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায়ও নামেন। তাঁদের সম্পদ নিয়ে দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
নির্বাচনী হলফনামা ও স্থানীয়ভাবে এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে এই দুই এমপিরই আড়াই হাজার কোটির সম্পদের তথ্য উঠে আসে। ২০১৪ সালেই দুদকের প্রাথমিক তদন্তে সাবেক এমপি এনামুলের হাজার কোটি টাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ তোলা হয়। এর বাইরে তিনি গত ১০ বছরে আরও অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। মালয়েশিয়ায়ও তাঁর সম্পদ রয়েছে।
আরেক বাগমারার এমপি আবুল কালাম আজাদের নিজ নামে ও স্ত্রীর নামেও রয়েছে বিপুল অর্থ। গত ৫ আগস্টের পর তাঁর মাছের খামারের কয়েকটি পুকুরে মাছ লুট হয়েছে। এই সাবেক এমপিরও অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করেছে। তিনি গত সাত মাসে পুকুর কেটেই অন্তত ৩০০ কোটি টাকা আয় করেন অভিযোগ এলাকাবাসীর। বাগমারার স্থানীয় বাসিন্দা আ: কাদের বলেন, ‘দুজনই শুধু টাকা কামিয়েছেন। একেকজনের হাজার কোটি টাকার নিচে সম্পদ নেই।’
উন্নয়নের চেয়ে টাকা কামাইতে ব্যস্ত ছিলেন দারা-মুনসুর
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক দুই এমপিও পলাতক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনবার এমপি হয়েছেন সাবেক সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা। এর আগেরবার এমপি ছিলেন মুনসুর রহমান।
অভিযোগ রয়েছে, দারা ২০০৮-১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পুঠিয়া-দুর্গাপুরে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতি করে। কথিত রয়েছে, কমিশনের টাকা আদায়ে তাঁর ভাই সুজাউদ্দিন ব্যাগ নিয়ে গিয়ে দুর্গাপুরে বসে থাকতেন ওই সময়।
সাবেক এমপি মুনসুরও একইভাবে ২০১৮-২৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি টাকা রাখার জন্য বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে সিন্দুকও করেছিলেন।
পুঠিয়া এলকার বাসিন্দা লৎফর রহমান বলেন, ‘দুই এমপি শুধু নিজেদের উন্নয়ন করেছেন। এলাকার কোনো উন্নয়ন করেননি। তাঁরা এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজন মিলে লুটপাট করে আঙুল ফুলের কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। এখন তাঁরা দুজনেই পলাতক রয়েছে।’
হাজার কোটি টাকার মালিক শাহরিয়ার
রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) শাহরিয়ার আলম রাজশাহী মহানগরীর বাসিন্দা হলেও তিনি ঢাকার তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী ছিলেন। ২০০৫ সালের তিনি রাজনীতিতে আসেন। চেষ্টা করেও বিএনপিতে ভিড়তে না পেরে সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেন শাহরিয়ার আলম। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ (টাকা, সোনা, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) ছিল দুই কোটি ৩২ লাখ টাকার। বার্ষিক আয় ছিল ৯৮ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে হলফনামায় শাহরিয়ার আলমের বার্ষিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় সাত কোটি ৯৩ লাখ টাকা। টানা তিন মেয়াদে এমপি থাকা শাহরিয়ার আলমের সম্পদ বেড়ে যায় প্রায় ৩০ গুণ। এছাড়ও স্ত্রী ও সন্তানদের নামে আছে সাড়ে সাত কোটি টাকার সম্পদ।
প্রতিমন্ত্রীর দুই ছেলেরও বার্ষিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৪ টাকা। দুই ছেলের অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে সাত কোটি ৪৫ লাখ টাকার। এসবের বাইরে তিনি অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে তাঁর একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু অভিযোগ করেন, ‘শাহরিয়ার নিজে সম্পদ গড়েছেন আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামেই একের পর মামলা করিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সিরাজও শতকোটি টাকার মালিক। আর শাহরিয়ার তো হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।’