ডা: মো: হাফিজুর রহমান (পান্না), রাজশাহী, বাংলাদেশ।
লোকসানেই চলছে রাজশাহী ওয়াসা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখনো লাভের মুখ দেখতে পারেনি ওয়াসা। সরকারকে প্রতি বছরই দিতে হচ্ছে ভর্তুকি। নতুন করে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে নন-রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস। নিয়ম অনুযায়ী সিস্টেম লস থাকার কথা ১০ শতাংশ। তবে বর্তমানে প্রায় ৩০ ভাগ ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে দেখানো হয়। প্রতি বছরই এই সিস্টেম লস দাঁড়াচ্ছে কোটি টাকার ওপরে। গত পাঁচ বছরে সিস্টেম লসের চক্করে পড়ে ওয়াসার রাজস্ব খাতের ৪১ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তবে ওয়াসা বলছে, ডিটেইলড মিটারড এরিয়া (ডিএমএ) সিস্টেম চালু হলে এটি কমে আসবে। এতো বিপুল পরিমাণের রাজস্ব হারালেও ওয়াসা। ওয়াসা বলছে, আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, এক ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে ওয়াসার খরচ হয় আট টাকা। ওয়াসার সরবরাহ করা এক হাজার লিটার সেই পানির দাম আবাসিক পর্যায়ে ছয় টাকা এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে ১২ টাকা রাখা হয়। কিন্তু নন-রেভিনিউ পানির কারণে প্রচুর টাকা গচ্চা যাচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠান চালুর শুরু থেকেই সিস্টেম লসের এই ক্ষতি ছিল। শুরুতে এটি ৫০ শতাংশ হলেও ধাপে ধাপে কমে এসেছে। তবু এখনো ৩০ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে।
ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরবরাহ লাইনে ত্রুটি ও অবৈধ সংযোগ সিস্টেম লসের বড় কারণ। সিস্টেম লস কমাতে পুরো রাজশাহীকে ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়ার (ডিএমএ) আওতায় আনতে হবে। কেননা ডিএমএ চালু হলে কত পানি উৎপাদিত হচ্ছে, কতটা ব্যবহৃত হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে হিসাব পাওয়া যাবে। এতে দুর্নীতি কমবে।
রাজশাহী ওয়াসার তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৮ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩১ দশমিক ৪০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৭ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ৩০ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৬ কোটি ১২ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ধরা হয় ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এই অর্থবছরে ওয়াসা নন-রেভিনিউ ওয়াটারের জন্য রাজস্ব হারায় ৯ কোটি ৮৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা। গত ৫ বছরে সিস্টেম লস বা নন-রেভিনিউ ওয়াটার থেকে রাজশাহী ওয়াসা রাজস্ব হারিয়েছে ৪১ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে সুপেয় পানির জন্য ২০১১ সালে শ্যামপুর এলাকায় ১০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এএইচএম কামরুজ্জামান নামে পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়। স্থাপনের এক দশক অতিবাহিত হলেও কখনোই এটি পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু হয়নি। এর দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি চালু থাকলে অন্যটি বন্ধ থাকে। মহানগরীতে দৈনিক সাড়ে ১৩ কোটি লিটার পানির চাহিদা থাকলেও এই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৯০ লাখ লিটার পানি পরিশোধন করা হয়। ফলে চাহিদা পূরণে গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে আরও ৯ কোটি ৮০ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করে রাজশাহী ওয়াসা। এতে রাজশাহী মহানগরী এলাকায় বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়েই ২ কোটি ৮০ লাখ লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া সিস্টেম লসে প্রতিদিন তিন কোটি লিটারেরও বেশি পানি নষ্ট হচ্ছে। এতে নগরীতে প্রতিদিন গড়ে পানির ঘাটতি ৫ কোটি ৮০ লাখ লিটার। যদিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়াসার পানি ব্যবহার করে না। তারা নিজস্ব প্রযুক্তিতে নিজেদের মতো করে পানি ব্যবহার করে।
সিস্টেম লস হলে এটা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা দরকার। কিন্তু প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা সিস্টেম লস হবে আর সেটা জনগণের টাকা থেকে যাবে সেটি কাম্য নয়। এজন্য তাদের দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। যাতে মানুষ এটা থেকে বের হয়ে আসে। তবেই এসব চোরাই লাইন ও সিস্টেম লস কমে আসবে। অন্যথায় পানির টাকা পানিতেই পড়তে থাকবে।
এদিকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর পরও থেমে নেই অবৈধ লাইন। রাজশাহীতে বিভিন্ন নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজই হচ্ছে অবৈধ লাইন নিয়ে। নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়ও চলছে লাইন। এক লাইন থেকে চায়ের দোকান, খাবার দোকান, এমনি হোটেল পর্যন্ত চালানো হচ্ছে। সরাসরি এসব লাইন মাটির নিচ থেকে নেওয়া হচ্ছে।
রাজশাহী মহানগরীর লক্ষীপুর এলাকায় ফুটপাতে দোকানদার মহিদুল ইসলাম বলেন, পাশে একটি ট্যাপ আছে। সেখানে থেকে পাইপের মাধ্যমে আমরা পানি ব্যবহার করি। পানি নিতে কোনো সমস্যা হয় না। যেহেতু এটি সরকারি লাইন, তাই পানির বিলও দিতে হয় না। রাজশাহীর সব খানেই এমন রাস্তার ধারে ট্যাপ দেখতে পাবেন। এসব ট্যাপ থেকে দোকান চালানো হয়। রাজশাহী মহাগরী প্রায় সব জায়গায় এধরণে ট্যাপ দেখা যায়।
রাজশাহী ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সোহেল রানা জানান, রাজশাহী ওয়াসার পানি পরিমাপে কোনো যন্ত্র নেই। তবে একটি সঠিক পরিমাপের মাধ্যমে নন-রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস ধরা হয়। মূলত অবৈধ লাইন, নির্মাণকাজে অবৈধ লাইন, লাইন ফেটে যাওয়া, লিকেজসহ নানান কারণে এসব হয়। এগুলোর পরিমাণ দিন দিন কমছে। তবে স্ট্যান্ডার্ড মাপ হলো ১০ শতাংশ। বিভিন্ন কারণে আমাদের বৈধ গ্রাহক হতে পারবেন না। অনেকে রাস্তার কাজ করছে, যারা ডেভেলপার সবাই এগুলো ব্যবহার করছে। পানির লাইন নেওয়া এত সহজ যে, যে কোনো একটি মিস্ত্রিকে বললে তিনি এই লাইন দিয়ে দিতে পারেন। এটা দৃষ্টিগোচরে এনে বন্ধ করতে না পারা পর্যন্ত আমাদের সিস্টেম লস হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ওয়াসা সিস্টেম লস পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে পানির দাম বাড়ানোরও যেমন প্রয়োজন হতো না, তেমনি তীব্র গরমেও অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে পানি সরবরাহ করা যেত। সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে না পারার পেছনে কৃর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মকেই দায়ী করছেন তারা।
রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেন, সিস্টেম লস নানান কারণে হয়। পানি তো উৎপাদন করতেই হচ্ছে। আমরা পাম্প ১৬ ঘণ্টা না চালালে পানির প্রেসার হয় না। আধুনিক সিস্টেমে দিতে না পারার কারণে মেন্যুয়ালি করতে হচ্ছে। মূলত পাম্প চালু না করলে পানির গ্রাহকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ফলে আমাদের সিস্টেম লস হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা অলরেডি ডিটেইলড মিটারড এরিয়া (ডিএমএ) সিস্টেম চালুর জন্য মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষা করেছি। আমাদের গোদাগাড়ী প্রজেক্টের সঙ্গে মার্জ করে এটি ডিপিপির মাধ্যমে এটি করা হবে। এটি হলে সিস্টেম লস কমে যাবে। এটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সিস্টেম লস নিয়ে কাগজে কলমেই আছি, অভিযানও পরিচালনা করছি। কিন্তু খুঁজে বের করতে পারছি না। অগোচরে থেকে যাচ্ছে অনেক কিছু। এ কারণে সিস্টেম লস হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলা সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, সিস্টেম লস হলে এটা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা দরকার। কিন্তু প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা সিস্টেম লস হবে আর সেটা জনগণের টাকা থেকে যাবে সেটি কাম্য নয়। এজন্য তাদের দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। যাতে মানুষ এটা থেকে বের হয়ে আসে। তবেই এসব চোরাই লাইন ও সিস্টেম লস কমে আসবে। অন্যথায় পানির টাকা পানিতেই পড়তে থাকবে।