শোভন গায়েন। কলকাতা সারাদিন।
কেন্দ্রীয় বাজেটে মধ্যবিত্তদের জন্য বিরাট স্বস্তি। মধ্যবিত্তদের জন্য বিরাট আয় কর ছাড় ঘোষণা কেন্দ্রীয় বাজেটে। বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কোনও কর দিতে হবে না। শনিবার বাজেট পেশ করে এমনই জানালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। শনিবার কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন, যাদের বার্ষিক আয় বছরে ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কোনও আয়কর দিতে হবে না।
নতুন কর কাঠামোর ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। ৫০ হাজার থেকে সেটা বেড়ে ৭৫ হাজার টাকা করার ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বাজেটে চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তদের দু-হাতে ভরিয়ে দিলেন নির্মলা সীতারমণ। প্রবীণ নাগরিকদের টিডিএসে ছাড় বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লক্ষ টাকা। হাউস রেন্টে টিডিএস ডিডাকশন বেড়ে হয়েছে ৬ লক্ষ টাকা। টিসিএস বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লক্ষ।
আজ নিজের বাজেট ভাষণে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, “বিশ্বের সব বড় অর্থনীতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল আমাদের অর্থনীতি। গত ১০ বছরে আমাদের উন্নয়নের ট্র্যাক রেকর্ড এবং কাঠামোগত সংস্কার বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ভারতের সামর্থ্য এবং সম্ভাবনার প্রতি আস্থা এই সময়ের মধ্যেই বেড়েছে। আমরা পরবর্তী ৫ বছরকে ‘সবকা বিকাশ’ উপলব্ধি করার একটি অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখছি। সমস্ত অঞ্চলের সুষম বৃদ্ধি হবে এই সময়কালে।”
পাশাপাশি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও বেশ কিছু ছাড় দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। একগুচ্ছ জীবনদায়ী ওষুধের দামে ছাড় থেকে ক্যান্সার-সহ ৩৬টি জীবনদায়ী ওষুধে পুরোপুরি শুল্ক প্রত্যাহার, দাম কমানো হয়েছে মেডিকেল সরঞ্জামেরও। এছাড়াও বিমা খাতেও বড় ঘোষণা করলেন নির্মলা। ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে বিমা খাতের জন্য প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ-এর সীমা ৭৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সম্পূর্ণ ১০০ শতাংশ করার ঘোষণা করেছেন। দেখা গিয়েছে, উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতে বিমার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কম। যত বেশি বিনিয়োগ আসবে ততই গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে এই বিমা ব্যবস্থাকে পৌঁছে দেওয়া সহজতর হবে।
বিমা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে চাকরির বাজারও বাড়বে সমানুপাতিক সম্পর্কে। পাশাপাশি বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজে সর্বোত্তম অনুশীলন যেমন পাওয়া যায় এবং প্রশিক্ষণের জায়গাটিও মজবুত হবে। কেন্দ্রের তরফে দাবি করা হচ্ছে এর মাধ্যমে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের আর্থিক পরিষেবা উন্নত করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে চলেছে আগামী দিনে। বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু শর্তাবলীও আছে। বাজেটে বলা হয়েছে যে সমস্ত বিমা সংস্থা তাদের সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম ভারতে লগ্নি করবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বর্ধিত এফডিআইয়ের নিয়ম প্রযোজ্য হবে। পাশাপাশি বিমাক্ষেত্রে আগের যে শর্তাবলী এবং বিদেশী বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রণকারী বিধানগুলি ছিল তা ফের পর্যালোচনা করা হবে এবং সরলীকৃত করা হবে।
একের পর এক জনমুখী প্রকল্পের ঘোষণা
২০২৫-২৬ বাজেটে নতুন ঘোষণা, জেলার হাসপাতালগুলিতে ক্যানসার কেয়ার ইউনিট খোলা হবে, যার মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি হবে। ২০০টি নতুন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করেন, তাদের অর্থনীতিতে অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার নথিভুক্তি প্রক্রিয়া শুরু করছে। এর ফলে প্রায় ১ কোটি গিগওয়ার্কার সরকারি সুবিধা পাবে। এটি তাঁদের কর্মজীবনকে আরও সুরক্ষিত করবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের অবদানকে আরও দৃঢ় করবে। এই পদক্ষেপগুলি দেশের স্বাস্থ্য ও শ্রমবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। নতুন স্কিম আনা হবে ৫ লক্ষ মহিলা, এসসি ও এসটি-দের জন্য। জানালেন অর্থমন্ত্রী। ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ৫ লক্ষ টাকার ক্রেডিট কার্ড, ঘোষণা অর্থমন্ত্রীর। কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের লোনের সর্বোচ্চসীমা ৩ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ করা হল। ইউরিয়া প্লান্ট তৈরি করা হবে।
পরিযায়ী হিসেবে কোথাও গিয়ে যাতে কাজ করতে না হয়, তার জন্য গ্রামাঞ্চলে উন্নতির বার্তা নির্মলার।
বিহারে তৈরি হবে মাখানা বোর্ড। দেশেই উৎপাদন হবে ভোজ্য তেল। কৃষক, নারী, ক্ষুদ্রশিল্পে গুরুত্ব দেওয়া হবে। ৭০ শতাংশ মহিলা যাতে আর্থিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, সে দিকে নজর দেওয়া হবে। দেশজুড়ে ১০ হাজার নতুন মেডিক্যাল সিট বৃদ্ধির ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী জানান, বাজেটে বিদ্যুৎ, কৃষি এবং ক্ষুদ্রশিল্প-সহ ছ’টি ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে। তফশিলি জাতি এবং তফশিলি উপজাতি মহিলাদের জন্য বিশেষ ঋণ কর্মসূচি। উদ্যোগপতি মহিলাদের আগামী পাঁচ বছরে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ। পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও বড় ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে একাধিক সুবিধার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, দেশের প্রায় সমস্ত সরকারি স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করেছে সরকার। এমনকি স্কুলগুলিতে ব্রডব্যান্ড পরিষেবা স্থাপন করা হবে। এছাড়াও, প্রযুক্তিবিদ্যায় জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। একাধিক আইআইটিতে আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করার কথা বলেছেন তিনি।
পাশাপাশি ‘ভারতীয় ভাষাপুস্তক প্রকল্প’ ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। যার মাধ্যমে ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় পড়াশোনা জোর দেওয়া হবে। আইআইটির আসনসংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে নির্মলা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের পর দেশে যে পাঁচটি নতুন আইআইটি রয়েছে সেখানেও সাড়ে ছয় হাজার ছাত্রছাত্রীকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে। এছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে।
এদিকে বাজেটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ ক্ষেত্রের জন্যে একাধিক ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আজ কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী জানান, এমএসএমই সংস্থাগুলির ঋণ নেওয়া আরও সহজ হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য কাস্টমাইজড ক্রেডিট কার্ড চালু করা হবে। এমএসএমই সংস্থাগুলির জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি কভার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হবে। এদিকে নতুন উদ্যোগগুলির জন্যে নতুন ‘স্টার্টআপ তহবিলে’ আরও টাকা ঢালা হবে। এই তহবিলে আগেই সরকার ১০ হাজার কোটি দিয়েছিল। এতে আরও ১০ হাজার কোটি যোগ করা হবে।
সম্পত্তি করেও এবারের বাজেটে বড়সড় কর ছাড় দিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। শনিবারের বাজেটে তিনি বলেন, কারও নিজের নামে থাকা দুটি সম্পত্তির বাৎসরিক মূল্যকে নিল বা শূন্য হিসেবে ধার্য করা যাবে। অর্থাৎ আয়কর ফাইল করার সময় যেকোনও দুটি সম্পত্তির বাৎসরিক মূল্যের জায়গায় শূন্য লেখা যাবে। ফলে ওই দুটো সম্পত্তির জন্য কোনও কর ধার্য করা হবে না। তবে কিছু শর্তও রয়েছে এই ক্ষেত্রে। নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মানলে তবেই কর মকুব করা হবে।
আয় করে ছাড়ের স্ল্যাব
নতুন আয়কর স্ল্যাব অনুযায়ী, শূন্য থেকে চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনও কর নেই। চার থেকে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ৫% আয় কর। ৮ থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ১০ শতাংশ কর। ১৬ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ২০ শতাংশ কর। ২০ থেকে ২৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ২৫ শতাংশ কর। ২৪ লক্ষ টাকার ওপরে আয়ে ৩০ শতাংশ আয় কর দিতে হবে। এদিন বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছেন, নতুন আয়কর আইন আগামী সপ্তাহে আনবে কেন্দ্র। আরও সরলীকরণ হবে কর কাঠামোর।
বাজেটে অগ্রাধিকার ভোট মুখী বিহারে
কয়েক মাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে তৃতীয় মোদি সরকারের অন্যতম শরিক দল জনতা দল ইউনাইটেড এর দখলে থাকা বিহারে। তাই এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে বিহার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা যেমন দিলেন বিহারের মধুবনী শাড়িতে, তেমনই ভাষণের কেন্দ্রবিন্দুতেও রইল নীতীশ কুমারের রাজ্য। বিহারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফুড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী। বিহারের মানুষের জন্য মাখনা বোর্ড তৈরি করা হবে। নির্মলা সীতারামন আরও ঘোষণা করেন, দেশজুড়ে পাঁচটি আইআইটির সম্প্রসারণ করা হবে। তার মধ্যে আছে পটনা আইআইটি-ও। এদিকে রাজগীর এবং ভাগলপুরে গ্রিনফিল্ডে বিমানবন্দর তৈরি করা হবে। এদিকে মিথিলাঞ্চলে ৫০ হেক্টরের ওপরে পশ্চিম কোসি প্রকল্পে সাহায্য করার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
“মধ্যবিত্তের বাজেট” দাবি প্রধানমন্ত্রীর
অস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে বাজেট পেশ করেছেন তা ভারতবর্ষের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য বলে দাবি করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংসদে বাজেট পেশের পরই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বললেন, “বাজেট খুব ভালো হয়েছে, সবাই আপনার প্রশংসা করছে।” পাশাপাশি, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্যের অভিযোগে বিতর্কে জড়িয়েছেন সনিয়া গান্ধী। কংগ্রেস সাংসদকে এবার পাল্টা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। ভারতের ১০ কোটি আদিবাসীকে সনিয়া অপমান করেছেন বলে পাল্টা আক্রমণ শানালেন নরেন্দ্র মোদী। দিল্লিতে জনসভা থেকে মোদী বলেন, “দ্রৌপদী মুর্মু আদিবাসী পরিবার থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ওঁনার মাতৃভাষা হিন্দি নয়, উড়িয়া। আজকের বাজেট অধিবেশনের ভাষণে সংসদের সকল সদস্যদের মুগ্ধ করেছেন তিনি। অথচ কংগ্রেসের শাহী পরিবার তাঁকে অপমান করতে উঠেপড়ে লেগেছে। শাহী পরিবারের এক সদস্য বলেছেন রাষ্ট্রপতি বিরক্তিকর ভাষণ দিয়েছেন। আরেক সদস্য এককাঠি উপরে উঠে রাষ্ট্রপতিকে বেচারা বলেছেন। আদিবাসী মায়ের ভাষণ ওদের ভালো লাগেনি। দেশের ১০ কোটি আদিবাসী ভাই-বোনেদের প্রতি এটা অপমান ছাড়া আর কিছু নয়।”