সুষমা পাল মন্ডল। কলকাতা সারাদিন।
কলকাতার রাস্তায় হঠাৎ যদি দূর থেকে চোখে পড়ে লাল রঙের পুরনো ডাবল ডেকার বাসটা, বুকের ভেতর একটা হালকা ধাক্কা লাগে। ধুলো উড়ছে, হেডলাইটের আলো ভেদ করে বাসটা এগিয়ে আসছে, আর তার সামনে ঝাঁকুনি খেতে খেতে লেখা “২বি”—এই দৃশ্য যেন সময়ের একটা জানালা খুলে দেয়।
এক সময় ছিল, যখন স্কুল-কলেজ ছুটির পর বন্ধুদের সঙ্গে ডাবল ডেকারে চড়ার আনন্দই আলাদা ছিল। ওপারের সিটে বসে জানালা দিয়ে বসন্তের হাওয়া গায়ে মাখা, ব্যাগটা পাশে ফেলে শহরটাকে নতুন চোখে দেখা—এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই ছিল জীবনের রঙিন অংশ।
ডাবল ডেকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল কলকাতার আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে। ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সময় এই লাল বাসগুলো নামানো হয়েছিল শহরের রাস্তায়। CSTC-এর বাঘমার্কা লোগোটা ছিল ডাবল ডেকারের গর্ব। ছোটবেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাঘের ছবি দেখে উত্তেজনায় কেঁপে উঠত মন — “একদিন আমিও চড়ব এই বাসে।”
সেই সময়কার কন্ডাক্টরের চেনা ডাক—“২বি, হেদুয়া, হাতিবাগান, শ্যামবাজার”—আজ যেন স্মৃতির ভিতরে অনুরণন তোলে। স্কুলের ইউনিফর্মের পকেট থেকে কয়েন বের করে টিকিট কাটা, জানালার ধারে বসে শহরের ব্যস্ততা দেখা—সব কিছুই ছিল কলকাতার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু সময় থেমে থাকে না। উড়ালপুল, মেট্রো আর ফ্লাইওভারের দাপটে শহরের রাস্তাগুলো বদলে গেল। ডাবল ডেকারের বিশাল কাঠামো জায়গা হারাতে লাগল। ২০০৫ সালের এক সকালে খবর এলো — আর ফিরবে না লাল বাস। শেষদিনে ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার অবধি যারা শেষবারের মতো উঠেছিল বাসে, তাদের চোখে ছিল অশ্রু, মনে ছিল একটাই প্রশ্ন — “এই শহর কি আর আগের মতো থাকবে?”
আজ ডাবল ডেকার শুধুই স্মৃতি। কারও অ্যালবামের পুরোনো ছবিতে, কারও ডায়েরির পাতায়, আর কারও মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো গল্পে—“আমাদের সময় ডাবল ডেকার বাস ছিল…” নতুন প্রজন্ম হয়তো জানবেও না, ওপার থেকে শহর দেখা কাকে বলে।

কলকাতা শহরের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি অলিতে এখনও যেন সেই লাল বাসটার নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। হয়তো কোনও এক ব্যস্ত ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখে হঠাৎই ভেসে ওঠে সেই পুরনো বাসটার ছবি। মনটা বলে ওঠে— “যদি আবার দেখা মেলে একদিন, সেই লাল ডাবল ডেকারের!”