উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যার সময় কলকাতায় দুর্গাপুজো কার্নিভালে উপস্থিত থাকার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করেছিলেন বিরোধীরা। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সহ একাধিক রাজনৈতিক নেতা প্রশ্ন তুলেছিলেন, “বন্যার সময় পুজো কার্নিভাল কেন?”
মঙ্গলবার উত্তরকণ্যায় বসে মুখ্যমন্ত্রী সেই সমালোচনার জবাব দিলেন শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায়। তিনি বললেন, “একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিতে হয় উদ্ধারের জন্য। কেউ কেউ রাজনীতি করছে, তখন কেন কার্নিভাল হল? আরে এটা বাংলার গর্ব।”
‘বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার গর্ব’
মমতা বলেন, দুর্গাপুজো বাংলার ঐতিহ্য এবং কার্নিভাল তারই একটি প্রতীক। “এই কার্নিভালের জন্য অনেক ক্লাবই অপেক্ষা করে থাকে। দেশ-বিদেশের অতিথিরা আসেন। ফরেন টুরিস্ট ছিল, ক্যান্সেল সম্ভব? এত ক্লাব আশা করে বসে আছে, তাদের কোনও মূল্য নেই?”— প্রশ্ন তুললেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, “তাছাড়া সেদিন গিয়ে আমি বা আমার টিম কী করতাম? আমাদের বা ভিআইপি দেখতে গিয়ে রেসকিউ হত না। পুলিশ কাকে সামলাবে? দমকল কাকে সামলাবে? বিপদের সময় তো মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো কাজ। নাকি শুধু ভিআইপিদের ট্রিটমেন্ট দেবে?”
‘পাহাড়ে চাপ পড়বে না, তিনটি গাড়ির বেশি নয়’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের ভৌগলিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন, “পাহাড়ে রাস্তা খারাপ। ঘনঘন গাড়ি নিয়ে ঢোকা বিপজ্জনক। ভিআইপির নাম করে ৩০-৪০টা গাড়ি নিয়ে ঢুকছে, এতে পাহাড়ে চাপ পড়ে। আমি নিজে তিনটে গাড়ি নিয়ে যাই— একটা সামনে, একটা মাঝে, একটা পিছনে। তাই স্ট্রিকলি বলেছি, আমাদের কেউ গেলে তিনটির বেশি গাড়ি নিয়ে যাবে না।”
‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে ব্যস্ত করতে চাইনি’
তিনি জানান, দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে সময় লাগে এবং সেই সময় প্রশাসনের ফোকাস থাকা উচিত মানুষের উপরে, রাজনৈতিক প্রোটোকল নয়। “২৪ ঘণ্টা ওদের টাইম দেওয়া হয়েছে উদ্ধারের জন্য। এমন অনেক ঘটনা হয়েছে যেখানে মা মারা গেছেন, বাচ্চারা বেঁচে আছে। আমরা যদি সেই সময় আসতাম, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেত। আমরা চাইনি সেটা ঘটুক,” বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি জানান, “ওই সময় অসহায় অবস্থার মধ্যে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হয়। তাই আমি ২১টা পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি, তাঁদের পাশে থেকেছি।现场ে না গিয়েও দায়িত্ব নিয়েছি।”
‘সব রাস্তা একসঙ্গে করা সম্ভব নয়’
উত্তরবঙ্গের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে মমতা বলেন, “প্রচুর বৃষ্টির কারণে পাহাড়ে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। PWD নতুন করে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করেছে। নাগরাকাটা ব্রিজের কাজ শুরু হয়েছে। রোহিণীতে কাজ চলছে, ১০-১১ দিনের মধ্যে শেষ হবে। মিরিকে নতুন ব্রিজ তৈরি হয়েছে— ভগবানকে ধন্যবাদ, চাপা পড়ে কিছু হয়নি।”
তিনি আরও জানান, “ছোট ছোট কাঠের ব্রিজ তলিয়ে গেছে, সেটা নতুন করে তৈরি হবে। এক মাস ধরে GR চলবে। যাদের সব কিছু চলে গিয়েছে, সরকার কিট দেবে— তাতে চাল, ডাল, জামাকাপড়, গ্যাস, বেবি ফুড— সব থাকবে। অনেক জায়গায় কমিউনিটি কিচেন চলছে।”
‘কেন্দ্র এক টাকাও দেয়নি’
রাজনৈতিক ক্ষোভও প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “আমাদের কেন্দ্র এক টাকাও দেয়নি। আমরা নিজেরাই কাজ শুরু করেছি। আগে যখন বন্যা হতো, মালদহ-বালুরঘাটে বসে মানুষ বলত, ‘দিদি খেতে পাইনি।’ এখন সেটা বদলে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে ১২ ঘণ্টায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ৫৬টা নদীর জল ছাড়া হয়েছে। সিকিমে ১৪টা হাইড্রেল পাওয়ার প্রজেক্ট আছে— তাই জল নামতে পারছে না। গরমে তিস্তায় জল নাই, বর্ষায় ডুবে যায়। ফ্লোরিডাতেও হাজার লোক তলিয়ে গেছে। পাহাড়ে ভূমিকম্প হয়, জঙ্গল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
‘আমি যাব, আবার ফিরব’
শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি কালকে চলে যাব, কিন্তু আবার দু’তিন দিনের মধ্যে আসব। কারণ বিড়লায় ও খড়গপুরে উদ্বোধন আছে— এক মাস আগে ডেট নেওয়া হয়েছে। তাই যাচ্ছি, কিন্তু উত্তরবঙ্গকে ছেড়ে যাচ্ছি না।”