সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
‘সেতু ১৫ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করে দেব। আগে এক মাস লাগবে বলেছিল। আপাতত হিউম পাইপ দিয়ে করে দেব। অস্থায়ী রাস্তা।’ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে উত্তরবঙ্গে গিয়ে এমন ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার মিরিকের দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে দুর্গতদের আশ্বাস দিলেন দুধিয়ার ভেঙে পড়া ব্রিজ ১৫ দিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। ভেঙে পড়া ব্রিজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সেতু ১৫ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করে দেব। আগে এক মাস লাগবে বলেছিল। আপাতত হিউম পাইপ দিয়ে করে দেব। অস্থায়ী রাস্তা। তবে বড় গাড়ি নয়, ছোট গাড়ি যাতায়াত করবে আর মানুষ হেঁটে যাব। রোহিনীর রাস্তা তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হবে। ওখানে ল্যান্ড স্লাইড হয়েছিল। রোহিনীর রাস্তা আমাদের মডেল রোড। আমার নজরে এসেছে ওখানে রাস্তার পাথর বেরিয়েছে।’
দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সোমবারই উত্তরবঙ্গে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার মিরিকের পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান তিনি। সেখান থেকে দুর্গতদের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা নাগাদ মিরিকের দুধিয়ায় পৌঁছোন মমতা। সেখানে স্বজনহারা কিছু পরিবারের সঙ্গে দেখা করে এক মাসের মধ্যে পরিবারের এক জনকে স্পেশ্যাল হোমগার্ডের চাকরি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। তা ছাড়া, উত্তরের পাঁচ জেলায় দুর্যোগের কারণে যে সব কৃষকের চাষের জমির ক্ষতি হয়েছে, তাঁদেরও পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেন মমতা। রাজ্যের কৃষি দফতর শস্যবিমার আওতায় কৃষকদের সুবিধা দেবে বলে জানান তিনি।
বন্যা এবং ধসের জেরে ঘরছাড়া হয়েছেন প্রচুর মানুষ। অস্থায়ী ঠিকানায় খাওয়া দাওয়া-সহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এদিন মমতা জানালেন, ‘ঘরবাড়ি বানানো হবে। এখন কমিউনিটি কিচেন চলবে। একাধিক কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। পোশাক, রান্নার সামগ্রী সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে রেশন দিতে হবে। নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত চলবে। বই, কাগজ, আধার ফেরতে স্পেশাল ক্যাম্প করা হবে। দুই পাড়েই করা হবে ক্যাম্প। রাস্তার কাজ দ্রুত করতে হবে। জল কমে যাওয়ার পরে সমীক্ষার কাজ শুরু হবে। যেখানেই কৃষকদের জমি নষ্ট হোক না কেন আমরা ক্রপ ইন্সসিওরেন্স করে দেব। কেউ ভাববেন না আমি ও সরকার পাশে আছি। গৌতম দেব, এল বি রাই ও অনীত থাপাকে বিশেষ দায়িত্ব আমি দিয়ে যাচ্ছি। আমি আবার আসব শীঘ্রই। আজ বিকেলে ঘোষণা করব।’
উত্তরবঙ্গে এই ভয়ানক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য যে ভুটানের প্রাকৃতিক অবস্থান অনেকখানি দায়ী তা মনে করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘ভুটানের ৫৬ নদী আছে। আজকেও হাই টাইড আছে। ভুটানের চার ড্যাম বন্ধ করেছে শুনলাম। সিকিমেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ওদের জল আসছে। গতকাল আমি তিস্তা দেখেছি। সিকিম আর ভুটানের জলে ক্ষতি হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। প্রকৃতির সঙ্গে এত লড়াই করলে এমন হয়। আমরা দুটো হাইডেল পাওয়ার করার চেষ্টা করেও করিনি। সিকিমে ১৪ হাইডেল পাওয়ার ওই ছোট রাজ্যে। মিরিক হল বেবি পাহাড়। সেখানে এত নির্মাণ কেন? চার দিন আমাদের সামলে থাকতে হবে। আজ থেকে আগামী তিন দিন আমাদের নজর রাখতে হবে। আমি এর থেকে আর বেশি কি বলতে পারি। আপনাদের যা হারিয়েছে তা আপনারাই বুঝেছেন। তবে যে চলে গেছে সে তো আর ফিরবে না। আপনাদের আমি দেখে রাখব।’
কমিউনিটি কিচেন ও জিআর চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে মমতা জানান, ‘নতুন পাকা সেতু, ৫৪ কোটি টাকা দিয়ে হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে হবে। ৪১ পাইপ দিয়ে অস্থায়ী সেতু/ রাস্তা হবে। যারা কাজ করছে তাদের যেন লাইফ জ্যাকেট দিতে হবে। কাজ করার সময় দেখবেন যেন বিপদ না হয়। সঙ্গে বোট ও ডুবুরি রাখতে হবে। বলেছিলাম হাই টাইড আসবে। দেখুন কীভাবে জলের স্রোত। আমি এই জন্যেই সবাইকে সাবধান করছি। এই স্রোতে কাজ দু’দিন পিছিয়ে দাও। আমাদের জীবন আগে দামি। এই স্রোত রাতে আরও বিপদজনক হবে।’

মঙ্গলবার বিকেলে মমতা জানান, এখনও পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যুর হিসাব পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে পাঁচ-ছ’ জন শিশু। নিহতদের মধ্যে ১৮ জন মারা গিয়েছেন মিরিক-কালিম্পঙে। নাগরাকাটায় আরও পাঁচ জনের দেহ মিলেছে। নেপাল ও ভূটানের দুই নাগরিকের দেহও মিলেছে। সকলের দেহ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। বুধবার দুপুরে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমে যাবেন নবান্নে। তার পর খড়্গপুরে যাবেন। এর মাঝে নিহতদের পরিজনদের চাকরি দেওয়া-সহ সরকারি কাজগুলি এগোবে। তার পর আগামী সপ্তাহের সোমবার ফের উত্তরবঙ্গে যেতে পারেন মমতা। শুকনো খাবার, জামাকাপড় থেকে শুরু করে যাবতীয় ত্রাণের কিট বিলি করা শুরু হবে। এ ছাড়া, নাগরাকাটা-সহ নানা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কমিউনিটি কিচেন চালানো হবে। যত দিন দুর্গতেরা নিজেদের ঘরে ফিরতে না পারছেন, তত দিন কমিউনিটি কিচেন চালানো হবে। কয়েক কোটি টাকার বিদ্যুতের খুঁটি জলের তলায় চলে গিয়েছে। সে সংক্রান্ত কাজও চলছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শর্টসার্কিট হয়ে কিংবা জমা জলে বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়ার মতো দুর্ঘটনা এড়াতে যাবতীয় সতর্কতা মেনে কাজ করা হচ্ছে।
মমতা বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে যা যা করার করে গেলাম, প্রশাসনিক কর্তারা বাকি কাজ করবেনই। কাল এখান থেকে বেরিয়ে গেলেও দু’তিন দিনের মধ্যে আবার ফিরে আসব। তত দিনে ফিল্ড সার্ভে করে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত খতিয়ান জানার সময়ও পাওয়া যাবে। দুর্যোগের রাতেই সতর্ক করে দিয়েছিল প্রশাসন। তাই আরও বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে। আমরা ঘটনা ঘটার পর পরই চলে এসেছিলাম। উদ্ধারের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। না হলে উদ্ধারকাজে কম গুরুত্ব দিয়ে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত জেলাপ্রশাসন। সেরকম হলে যারা বেঁচে ফিরে এসেছে, তাঁদের আরও অনেকে মারা যেতে পারতেন। প্রচুর বাড়ি, রাস্তা ভেঙেছে। অনেক জায়গায় সেতুও ভেঙেছে। জল একটু নামলে ফিল্ড স্টাডি শুরু হবে। আর ওই দিন যদি আসতাম, আমাদের মতো ভিআইপিদের দেখতে গিয়ে জেলা প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? দুর্গতদের উদ্ধার করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ত্রাণ দেওয়া? নাকি শুধু ভিআইপিদের দেখাশোনা করা? ভিভিআইপিরা কেউ কেউ ৩০-৪০টি গাড়ির কনভয় নিয়ে যাতায়াত করছেন। এত গাড়ির চাপে গ্রামীণ রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে, কেউ গেলে তিনটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না।’