সুষমা পাল মন্ডল। কলকাতা সারাদিন।
নির্বাচনী স্বৈরাচার দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে বারে বারে একই ব্যক্তি অথবা একই রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় ফিরে ফিরে এলে তাদের মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবণতা তৈরি হতে পারে। আর শাসকের মধ্যে যখনই স্বৈরাচারী প্রবণতা তৈরি হয় সেখানেই বপন হয় গণতন্ত্রের পতনের বীজ। এমন আশঙ্কার কথা উঠে এল কলকাতা তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রথম সারির কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপকদের আলোচনায়।
সম্প্রতি সোনারপুরের জ্যোতির্ময় ল কলেজের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল বাৎসরিক ল ফেস্টিভ্যাল অন্বেষণ। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তথা জ্যোতির্ময় ল ও কলেজের কর্ণধার ডঃ পার্থ সারথি গাঙ্গুলীর উপস্থিতিতে এই ল ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী আলোচনা চক্রে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের বিভাগীয় প্রধান যতীন্দ্র কুমার দাস থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, যোগেশচন্দ্র ল কলেজ, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের আইন বিভাগের অধ্যাপিকা সহ চন্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের গবেষকরা।
Electoral Autocracy and Fall of Democracy : Legal challenges and the way forward.
তিন দিনব্যাপী এই ল ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর পার্থ সারথি গাঙ্গুলী বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে একটা সুস্থ গণতন্ত্র তখনই সুস্থ ভাবে পথ চলতে পারে যখন সেই দেশের ভোটাররা গণতান্ত্রিকভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে। একটা দেশে যদি প্রত্যেক বছর বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয়ে যায় তার বড়সড়ো প্রভাব পড়ে দেশের শিক্ষার জন্য বরাদ্দ হওয়া বাজেটে। ভোট প্রক্রিয়া অথবা অন্যান্য যে কোন প্রক্রিয়ার থেকে বেশি জরুরী দেশের নাগরিকদের শিক্ষিত করে তোলা। আশা করব ভবিষ্যতে দেশের সরকার এই বিষয়টির দিকে বাড়তি নজর দেবে।”
তবে সাম্প্রতিককালে যেভাবে কেন্দ্রে ক্ষমতা আসেন সরকার অথবা বিভিন্ন রাজ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বারে বারে ভোটে জিতে এসে সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখছে তার ফলে সেই সমস্ত সরকার বা সরকারের কর্ণধারদের মধ্যে স্বৈরাচারী মানসিকতা ফুটে উঠছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বহু ইতিহাসবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদ।
অবিলম্বে শাসকের এই স্বৈরাচারী মনোভাব যদি আটকানো না হওয়া সম্ভব হয় তাহলে দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়বে বলেও এদিনের সেমিনারে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আইনের বিশিষ্ট অধ্যাপক অধ্যাপিকারা।
বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন সহ দেশের বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থাকে ক্ষমতার জোরে কুক্ষিগত করার প্রবণতাও অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে বলে উঠে আসে দিনের আলোয়।
এই পরিস্থিতি থেকে দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ভারতবর্ষের বিচার ব্যবস্থাকে আরো সময়োপযোগী এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে কঠোরভাবে সংবিধানের রক্ষা কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন গবেষকরা।
চন্ডিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক তথা নির্বাচনী গণতন্ত্র বিষয়ক গবেষক জামশেদ কাজিমি বলেন, “নির্বাচনের নামে দেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বুকে চালু হচ্ছে নির্বাচনী স্বৈরাচার। যেখানে শাসকদলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কোন গন্ডগোলের অভিযোগ নিয়ে বিচার ব্যবস্থার কাছে গেলে আজ পর্যন্ত সেই নির্বাচনকে পক্ষপাত দুষ্ট অথবা সম্পূর্ণ নতুন করে সেই নির্বাচন গ্রহণ করার কোন নির্দেশ ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সাম্প্রতিককালে দিয়েছে বলে কোনো নজির নেই। তাই অবিলম্বে দেশের গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে গণতান্ত্রিক সরকারের ছদ্মবেশে স্বৈরাচারী কায়দায় যেভাবে কুক্ষিগত করা হচ্ছে তাকে রক্ষা করার জন্য দেশের বিচার ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ এবং সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।”
দেশ জুড়ে যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেই সময় জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও কঠোর ভূমিকার পাশাপাশি ক্ষমতাসীন সরকারের ওপরে কমিশনের নির্ভরশীলতা কমানোর বিষয়ে জোরালো সওয়াল করেন কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন যতীন্দ্র কুমার দাস।
তবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভারতীয় সংবিধানের ছত্রে ছত্রে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দলকে যে বিপুল ক্ষমতায় তুলে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে স্বৈরাচারের বীজ বপন করা হয়েছিল বলে ব্যাখ্যা করেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তথা এসোসিয়েট প্রফেসর ঝুম্পা মুখোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান প্রনেতারা যখন সংবিধান লিখেছিলেন সেই সময় সংবিধানের মুখবন্ধে গণতন্ত্র বা দেশের মানুষের অধিকারের কথা উল্লেখ করলেও সংবিধানের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের মানুষের কথা শোনার জন্য ক্ষমতাসীন শাসক দল অথবা সরকারকে বাধ্য করার জন্য সেই ধরনের কোন নির্দেশিকা দেওয়া নেই। যা কার্যত কেন্দ্রে ক্ষমতাশীন সরকারকে স্বৈরাচারী ভূমিকা নিতে অনেকাংশে সহায়তা করে।