সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
“সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।” বাকি সব তীর্থে বারবার যাওয়া গেলেও গঙ্গাসাগর তীর্থে একবার পৌঁছনোই বড় ব্যাপার। এই প্রবাদ বিখ্যাত।
সাগরদ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সুন্দরবনাঞ্চলের এই দ্বীপটিরই পৌরাণিক নাম শ্বেতদ্বীপ। এরই দক্ষিণাংশে গঙ্গা যেখানে সাগরের সঙ্গে মিলেছে, সেই স্থানটি গঙ্গাসাগর নামে খ্যাত। সামনে আদিগন্ত সমুদ্র, পেছনে শ্যামল বনানী আর বালুকাময় বেলাভূমির মাঝখানে মহর্ষি কপিলের মন্দির। হিন্দু-মানসে গঙ্গাসাগর একটি মহাতীর্থ হিসেবে গণ্য। সাগরতীরের সার কথা মকর-সংক্রান্তিতে সাগর সঙ্গমে পুণ্যস্নান। তাই যুগ যুগ ধরে সাধুসন্ত ও মোক্ষকামী মানুষের এত ভিড়।
নানা বয়সের নানা মুখ, নানা অভিব্যক্তি৷ পুণ্যলাভের আশায় হাজার হাজার মাইল ছুটে আসা ভক্তকূল, ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী, দেশি-বিদেশি অতিথি। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে সব মিলে মিশে একাকার। মকর সংক্রান্তির পূণ্যলগ্নে গঙ্গাসাগর হয়ে ওঠে এক মহামিলন মেলা। কেন? লক্ষ লক্ষ ভক্ত ভিড় জমান গঙ্গাসাগরে কেনই বা বাংলার এই তীর্থক্ষেত্রের এত মাহাত্ম্য?
হাজার বছর ধরে নিজেদের অনেক ঝুঁকি নিয়ে এই মহাতীর্থে আসেন মানুষ। নিজেদের পাপ থেকে মুক্তি পেতে এই তীর্থে আসেন মানুষ । বর্তমানে গঙ্গাসাগর তীর্থের পথ অনেক সুগম হয়েছে। তবে পথ ছিল বিপজ্জনক । ছিল সাগরে নৌকাডুবি হওয়ার ভয়, অন্যদিকে ছিল জলদস্যুর আতঙ্কও।
এককালে সাগরদ্বীপ ছিল ১৭০ বর্গ মাইলের এক সমৃদ্ধ জনপদ। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সামুদ্রিক ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে সাগরদ্বীপের প্রায় দু’লক্ষ মানুষ সমুদ্রের টানে ভেসে যায়। সেই থেকে দ্বীপটি বহুকাল জনহীন এবং শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দে বিদেশি বণিক এবং ইংরেজরা সাগরদ্বীপকে পরিত্যক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। হবসন জবসন অভিধানে এই দ্বীপের উল্লেখ আছে। জেমস প্রাইস নামে এক ইংরেজের লেখায় দেখা যায়, সাগরদ্বীপের নাম গঙ্গাসাগর।
১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে হেজেস এখানে একটি হিন্দুমন্দির দেখতে পান। এখানকার রাজা নাকি বছরে দু’লাখ টাকা তীর্থকর আদায় করতেন। পরে লুইল্লিয়ার নামে আর এক সাহেব সাগরদ্বীপে দুই সাধুকে দেখেছিলেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে আলেকজেণ্ডার হ্যামিলটনের বিবরণ থেকে জানা যায়, সাগরদ্বীপ হিন্দুদের কাছে খুবই পবিত্র তীর্থস্থান। প্রতি বছর শীতে বহু সাধু ও তীর্থযাত্রী এখানে স্নান করতেন এবং পুজো দিতেন।
যুগ যুগ ধরে মকর সংক্রান্তিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই সাগর তীর্থে আসেন। জ্যোতিষ মতে,সূর্য মকর সংক্রান্তিতে মকর রাশিতে প্রবেশ করে।
বিশ্বাস করা হয়, যে এই তিথিতে গঙ্গাস্নান করলে ১০০টি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সমান পুণ্য লাভ হয়। তাই এদিন গঙ্গাসাগরে এত মানুষ সমবেত হন।
পুরাণ অনুসারে অযোধ্যার ইক্ষাকু বংশের রাজা সগর। তিনি একবার অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন।
মুক্তিতীর্থ গঙ্গাসাগর নিয়ে প্রচলিত আছে এক পুরা কাহিনি। অযোধ্যার সূর্যবংশের পরাক্রান্ত রাজা সগর নিরানব্বুই অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপনান্তে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন শততম যজ্ঞে। এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে পারলে তিনি স্বর্গরাজ ইন্দ্রের সমপর্যায়ে উন্নিত হবেন।
ইন্দ্র সগররাজের শততম যজ্ঞ পণ্ড করতে অশ্বমেধের ঘোড়া চুরি করেছিলেন। তারপর গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির আশ্রমের কাছেই তিনি লুকিয়ে রাখেন ঘোড়াগুলিকে।
অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়ম অনুসারে সেই ঘোড়া খুঁজতে আসে সাগর রাজার ৬০ হাজার পুত্র। কপিল মুনির রোষের মুখে পড়েন তাঁরা। তাঁদের ভষ্ম করে দেন কপিল মুনি।
পুরাণ মতে, সগর রাজার মৃত ৬০ হাজার সন্তানকে জীবন ফিরিয়ে দিতে তাঁর নাতি ভগীরথ মর্ত্যলোকে গঙ্গাকে নিয়ে এসেছিলেন। তাই মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গা এবং সাগরের সঙ্গমে স্নান করলে অসীম পুণ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে পুরাণে।
ইতিহাসের পাতাতেই নয়, মৎস্য, বায়ু এবং পদ্মপুরাণ শাস্ত্রেরও সাগরতীর্থ সম্পর্কে নানা কথা আছে। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ এবং মধ্যযুগের কয়েকটি মঙ্গলকাব্যেও ছড়িয়ে আছে গঙ্গাসাগর প্রসঙ্গ। ‘মহাভারতে’-এর বনপর্বে দেখা যায়, স্বয়ং যুধিষ্ঠির সাগরসঙ্গমে এসেছিলেন মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙের বিবরণেও গঙ্গাসাগর স্থান পেয়েছে।
খ্রিস্টিয় ৪৩৭ অব্দে ওখানে একটি প্রচীন মন্দিরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। কিন্তু নদীর পথ পরিবর্তনের ফলে সে মন্দির সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর পরেও দু’বার মন্দির নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রগ্রাসে কোনওটাই স্থায়ী হয়নি। বর্তমান মন্দিরটি আদি মন্দির স্থল থেকে প্রায় দুই কিমি দূরে অবস্থিত। ১৩৮০-৮১ (ইং ১৯৭৩-৭৪) বঙ্গাব্দে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে এটি তৈরি করেন অযোধ্যার হনুমানগড়ি মঠের মোহন্ত রামদাসজি মহারাজ। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে উইলসন সাহেবের বর্ণনানুযায়ী মন্দির চত্বরে ছিল প্রকাণ্ড এক বটবৃক্ষ, যার পাদদেশেই ছিল শ্রীরাম ও হনুমানের মূর্তি। মন্দিরাভ্যন্তরে আজও বিরাজমান লালসিঁদুরে পরিলিপ্ত শিলাময় কতিপয় বিগ্রহ। প্রথমেই চোখে পড়ে পদ্মাসনে যোগারুঢ়, জটাশ্মশ্রুমণ্ডিত মহাযোগী কপিল, যাঁর বামহস্তে কমণ্ডুল, ঊর্ধে উত্থোলিত দক্ষিণ-করে জপমালা। শিরোদেশে পঞ্চনাগ-ছত্র। ডানপাশে চতুর্ভুজা মকর বাহিনী গঙ্গাদেবী, যাঁর অঙ্কে মহাতাপস ভগীরথ। স্বল্পদূরে গদা ও গন্ধমাদন পর্বত হস্তে মহাবীর হনুমান। কপিল বিগ্রহের বাঁয়ে ষাট সহস্র সন্তান বিয়োগ বেদনায় মুহ্যমান নগররাজ, যিনি মহর্ষি কপিলের করুণায় বীতশোক। রাজমূর্তির বাঁয়ে অষ্টভুজ সিংহবাহিনী বিশালাক্ষীদেবী। সর্ব বাঁয়ে অশ্বের বল্গাহস্তে ইন্দ্রদেব।
তাই কপিলমুনির আশ্রম দর্শন ও সাগর স্নান এত গুরুত্বপূর্ণ।
পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজ বণিকরা বাণিজ্যের উন্নয়নের জন্য বেছে নিয়েছিলেন সুন্দরবনের খাড়ি আর সাগরসঙ্গমের দ্বীপগুলি। বলতে গেলে ইংরেজরাই সাগরের পুনরুজ্জীবন ঘটান। তাঁরাই যে জঙ্গালাকীর্ণ সাগরদ্বীপে ফের বসতি গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তার সমর্থন পাওয়া যায় ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের (৩০ কার্তিক, ১২২৫) ‘সমাচার দর্পন’-এ। ওই বছর ১৪ নভেম্বর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘যাহারা গঙ্গাসাগর উপদ্বীপে বসতি করাইবার উদ্যোগ করিতেছে, তাহারা কলিকাতার এক্সচেঞ্জে অর্থাৎ ক্রয়বিক্রয়ের ঘরে গত বুধবার একত্র হইল এবং দশ জন সাহেব ও দুই এতদ্দেশীয় লোককে সেই কর্ম সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত নিযুক্ত করিল…।’’
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চার আনা খাজনায় সাগরদ্বীপের ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু সাগরমেলার বর্তমান বাড়বাড়ন্তের নেপথ্যে ইংরেজদের অবদান থাকলেও সাগর উন্নয়নে সেই সময় তাঁদের প্রচেষ্টা খুব যে ফলপ্রসূ হতে পারেনি তার অন্যতম কারণ উপর্যুপরি সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝা ও জলপ্লাবন। ১৮৩৩ ও ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের সাইক্লোন সাগরদ্বীপকে তছনছ করে দেয়। শুধুমাত্র ১৮৬৪-র ঝড়ে পাঁচ হাজার জনের মৃত্যু। এর ফলে দ্বীপের লোকসংখ্যা অনেক কমে যায়। তা হলেও দ্বীপোন্নয়নের কাজ থেমে থাকেনি। বনাঞ্চল মুক্ত করে সেখানে চাষবাদ, হাটবাজার এবং মহাজনের গোলাস্থাপনের ব্যবস্থা হয়েছে। সেই সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও।