সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
”সিনিয়র চিকিৎসকরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করলে প্রসূতি এবং সদ্যোজাতদের এই পরিণতি হত না। একই স্যালাইনে তো অন্য জায়গায় কিছু হয়নি। এখানে গাফিলতি হয়েছে, এমএসভিপি বা হেড অফ ডিপার্টমেন্ট কোথায়? সরকার কি স্যান্ডুইচ হবে নাকি সঠিক তথ্য দেবে। যা ঘটেছে তাই বলেছি।” মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজের মেয়াদ উত্তীর্ণ স্যালাইন দেওয়ার ফলে প্রস্তুতি মৃত্যুর যে অভিযোগ উঠেছিল তার তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে আজ কর্তব্যরত চিকিৎসকদের গাফিলতিকেই দায়ী করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বৃহস্পতিবার নবান্নে সাংবাধিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানিয়েছেন, সঠিকভাবে চিকিৎসকদার দায়িত্ব পালন করলে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ওই মা ও সদ্যোজাতকে বাঁচান যেত। এই ঘটনায় ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিলেন মমতা।
মেদিনীপুরে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় এদিন মুখ্যসচিব এবং স্বাস্থ্যসচিবকে পাশে বসিয়ে সরকারি রিপোর্ট সামনে এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “নেগলিজেন্স ইজ অলসো আ ক্রাইম! হাসপাতালের সুপার, এইচওডি কী করছিলেন? যারা জানে না তাদের পাঠানো হয়েছিল। ভুল ভাল অ্যানাস্থেসিয়া দেওয়া হয়েছে। তাই মেদিনীপুরের ঘটনা।” এও জানিয়ে দিলেন, “মানুষের প্রাণের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। তাই কারও গাফিলতি থাকলে তাকে বরদাস্ত করা হবে না।”
ইতিমধ্যে ঘটনায় মেদিনীপুরের সুপার-সহ ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করা হয়েছে জানিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বলেন, “আপনারা কি মনে করেন না, অ্যাকশন নেওয়া দরকার ছিল। না নিলে তো আপনারাই বলতেন, নেওয়া হল না কেন? তাহলে গভর্নমেন্ট কোনটার মধ্যে যাবে? স্যান্ডউইচ হবে নাকি যেটা সত্য সেটা সামনে আনবে। তাই কোনও কিছু না লুকিয়ে আসল ঘটনা সামনে আনা হল।”
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এক প্রসূতি ও সদ্যজাতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েদিন ধরে তোলপাড় রাজ্য। ঘটনায় গাফিলতি ডাক্তারদের বলেই বৃহস্পতিবার স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন মমতা। এই ঘটনায় হাসপাতালে আরএমও, এমএসভিপি-র সিনিয়র চিকিৎসক এবং জুনিয়র চিকিৎসক মিলিয়ে একসঙ্গে ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করল রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর জানালেন, ”সিনিয়র চিকিৎসক ও সিআইডি রিপোর্ট মিলে গিয়েছে। মানুষ জানতে চায় আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই স্যালাইন অনেক রাজ্যে এখনও চলছে। এর মধ্যে অন্য কাহিনী থাকতে পারে। সেই কাহিনীতে আমরা যাব না। আমরা আবার পরীক্ষা করছি। ভাল বিকল্পের সন্ধান করেছি।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন, ওটির ভিতর সিসি ক্যামেরা থাকলে অভিযুক্তদের হাতেনাতে ধরা যেত। অপারেশন থিয়েটারের ভিতরেও সিসি ক্যামেরা থাকা উচিৎ বলেও মনে করেন তিনি। একই সুর শোনা গিয়েছে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের গলায়। তিনি বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা করিডরে থেকে। তাই চিকিৎসকদের গতিবিধি জানতে পারছি না।’ তবে মুখ্যমন্ত্রীর মতোই তিনিও বলেছিলেন, ‘অস্ত্রোপচারের সময় যে প্রোটোকল মেনে চলা দরকার। তা মানা হয়নি।’ সিনিয়র চিকিৎসকরা উপস্থিত না থাকায় জুনিয়র ডাক্তাররাও অপারেশন করেছিলেন বলেও তিনি অভিযোগ করেছিলেন।
পাশপাশি মুখ্যমন্ত্রী জানান, “কোনও এক পপুলার হাসপাতালে এক এডিটর নিউজ হাউজের ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসক যোগী ও সিনিয়র এক ডাক্তার দেখছিলেন। আমি দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে গলায় তিন জন স্টেথো ঝুলিয়ে এসে তাকে বললেন আরে আপনার ক্রিয়েটিনিন হাই, আপনাকে ডায়ালিসিস করতে হবে। সব না জেনে কমেন্টস করা, ফাইলে লেখা, যে রোগী ভাল হয়ে যাচ্ছিল, তাকে আবার ধাক্কা দেওয়া। সিনিয়র বা হেড অফ ডিপার্টমেন্ট ট্রেনিদের নিয়ে যাবে সঙ্গে করে।”
বহু ক্ষেত্রে জুনিয়র চিকিৎসকদের দিয়ে অপারেশন করানোর অভিযোগ ওঠে। জনমানসের সেই অভিযোগকে কার্যত মান্যতা নিয়ে এদিন নবান্নের সাংবাদিক বৈঠক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রশ্ন তুলেছেন, “সব কেসে সিনিয়ররা বা এইচওডি, সিস্টাররা সঙ্গে থাকবেন না কেন? এগুলোতে ভাল করে নজরে রাখতে হবে। কারণ, বাংলার বদনাম বরদাস্ত করব না। বলা হয়, তুলো ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। অথচ এখন সরকারি হাসপাতালে সব কিছু পাওয়া. যায়। এখানে অনেকে বিশ্ব সেরা চিকিৎসকও রয়েছেন। তবু গাফিলতি হচ্ছে। এর জন্য আমরা দায়ী নই। এক্সামিনেশন সিস্টেম দায়ী। এক্সামিনেশন আমরা করি না। এটার ব্যাপারে এমএসভিপি, এইচওডিকে বিশেষ কেয়ার নিতে হবে।”
কীভাবে এই এক্সামিশান সিস্টেমে বদল আনা যায়, তার জন্য একটি বিদেশি সংস্থার সাহায্যে রাজ্যের চিকিৎসক ও নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ধারাবাহিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে বলেও জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “কাউকে দোষারোপ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য বাংলার মানুষকে আরও ভাল পরিষেবা উপহার দেওয়া।”