সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
অবশেষে কাটলো জট। দীর্ঘ ৩৮ দিন ধরে আরজিকর কাণ্ডের জেরে জুনিয়র ডাক্তাররা যে কর্ম বিরোধী চালিয়ে যাচ্ছিলেন তার সমাধানের জন্য পঞ্চম বার মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বৈঠকে বসলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এই বৈঠকেই জুনিয়র ডাক্তারদের প্রধানতম দাবি মেনে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে অপসারণের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকেও তাঁদের পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সন্ধে ৬টা ৪০ মিনিট থেকে টানা ঘণ্টাদুয়েক বৈঠক হয়। তারপর প্রায় ৫ ঘণ্টা পরে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বেরোয় জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দল। তারপরেই রাত প্রায় ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমাদের মিটিং চলেছে- ৬টা থেকে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১২টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে জুনিয়র ডাক্তাররা বেরিয়ে গেলেন। জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষ থেকে ৪২ জন মিনিটসে সই করেছেন। রাজ্যের তরফে মুখ্যসচিব সই করেছেন। আমরা উভয়পক্ষ খুশি এতক্ষণ মিটিং করতে পারলাম বলে। ওরা যা বলতে চেয়েছিলেন সেটা রাখতে দিয়েছি। আমাদের বক্তব্য আমরা চেষ্টা করেছি ওদের গুরুত্ব দিয়ে করার।”
তিনি আরো বলেন, “ওদের ৫ দফার দাবি ছিল। প্রথমটা সিবিআই করছে। ওটা আমাদের হাতে নেই। বাকি ৪টি দাবি ছিল। ৩টি নাম দিয়েছিল- আমাদের ওদের বোঝালাম একসঙ্গে পুরো ঘর খালি করলে প্রশাসন চলবে কী করে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেহেতু ছাত্র-ছাত্রীরা বলেছেন, ওদের বক্তব্য গুরুত্ব দিয়েছি।” প্রসঙ্গত আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা দাবি করেছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবকেও সরিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে তা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি জানান, “আগামীকাল বিকেল ৪টার পরে কলকাতা পুলিশে বদল আনব, কাল বিকেল ৪টার পরে আরও কিছু রদবদল আনব, বিনীত যেখানে কাজ করতে চেয়েছেন, সেখানে পাঠানো হবে। আরও কিছু বদল আসবে পুলিশের কিছু পদে।” ডিসি নর্থের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল। তাঁকেও সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়ার আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর।
আরজি করের ঘটনার পর ইতিমধ্যে রাজ্যের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুরক্ষা এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নে ইতিমধ্যে রাজ্য উদ্যোগী হয়েছে। এদিনের বৈঠক থেকে এ ব্যাপারে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এর আগে গত শনিবার আচমকাই স্বাস্থ্যভবনে জুনিয়র চিকিৎসকদের ধর্না মঞ্চে পৌঁছে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি বলেছিলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নই, বড়দিদি হয়ে এসেছি। একজন সমব্যাথী হিসেবেই কথা বলতে এসেছি।” আলোচনার মাধ্যমে দাবি মেটানোর আশ্বাসও দেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরপরই বরফ গলতে শুরু করে।
অন্যদিকে, জুনিয়র চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, “আন্দোলনের চাপে সিপির পদত্যাগের দাবি মানা হয়েছে। ৫ দফা দাবি শোনা হলেও কিছু মানা হয়েছে, কিছু মানা হয়নি। আমরা খুশি নই।”
রাত বারোটা চল্লিশ নাগাদ সল্টলেকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, “আমাদের কয়েকটি দাবী মেনে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার পুলিশ কমিশনার, ডি সি নর্থ, স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকার তাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের আরেকটি দাবি এখনো পর্যন্ত অসম্পূর্ণ। আমাদের দাবি মেনে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবকে সরানো হয়নি। তাই এখনই আমরা কর্ম বিরতি তুলছি না।”
আজ, সোমবার কালীঘাটে বৈঠকে বসার জন্য ফের জুনিয়র ডাক্তারদের মেইল করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব। কখন বৈঠক? বিকেল ৫টায়। এরপর বৈঠকে বসেন জুনিয়র ডাক্তাররা। শেষপর্যন্ত পাল্টা মেইলে কালীঘাটে বৈঠকে বসতে রাজি হন আন্দোলনকারীরা। ঠিক হয়, বৈঠক চলাকালীন পুরো মিনিটস নথিবদ্ধ করতে হবে। বৈঠক শেষের অব্যবহিত পরেই দু’পক্ষ সই করবে সেই মিনিটসে। বৈঠকে যোগদানকারী প্রত্যেকের হাতে এই মিনিটসের কপি তুলে দিতে হবে। এ দিন সন্ধ্যা ৬.৪০ মিনিট নাগাদ কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে শুরু হয় জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক। দু জন স্টেনোগ্রাফার সহ প্রায় চল্লিশ জনের একটি দল এ দিনের বৈঠকে যোগ দিয়েছিল বলে সূত্রের খবর। বৈঠক শেষ হয় রাত ৮:৪৫ মিনিটে। এরপরে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা বৈঠকের মিনিটস খতিয়ে দেখার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাসভবন থেকে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা রাত এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটে বেরিয়ে যান।
মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও রাজ্যের পক্ষ থেকে বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, ডিজি রাজীব কুমার, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যরা।