সুহানা বিশ্বাস। কলকাতা সারাদিন।
আগামী ১ অগাষ্ট থেকে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজ শুরু করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ১০০ দিনের কাজ শুরু করতে যে কোন শর্ত আরোপ করতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু দীর্ঘদিন একটি প্রকল্পের কাজ আটকে রাখা যাবে না। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। বুধবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি চৈতালি চট্টোপাধ্যায় দাসের ডিভিশন বেঞ্চে এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনাম কেন্দ্রের মোদি সরকারের টানাপোড়েনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বরাদ্দ। সেই ১০০ দিনের কাজ নিয়ে এবার কড়া নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের। আগামী ১ অগাস্ট থেকে রাজ্যে ফের ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু করতে হবে বলে নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকারকে। কলকাতা হাইকোর্ট সাফ জানিয়েছে, অনন্তকালের জন্য কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না। প্রয়োজনে দুর্নীতি প্রতিরোধী যে কোনও শর্ত আরোপ করুক কেন্দ্র। কিন্তু প্রকল্প চালু করতে হবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, “শুরু থেকে এই একটা কথা বলছি দশটা আপেলের মধ্যে কয়েকটা পচা হতে পারে কিন্তু বাকিরা তো স্বচ্ছ।” তাঁর কথায়, “যা হয়েছে সেটা অতীত কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে প্রকল্প বন্ধ এবার নতুন করে চালু করতেই হবে কেন্দ্র এই প্রকল্প স্থগিত রাখতে পারে না।” প্রধান বিচারপতি এরপরই বলেন জুলাই বা অগাস্ট থেকে চালু করা যায় কিনা এই প্রকল্প তা ভেবে দেখুন।
মনরেগা প্রকল্পের আওতায় ১০০ দিনের কাজ গ্রামাঞ্চলে রোজগারের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের টানাপোড়েনে সেই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ টাকা আটকে যায়। বিজেপি নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই জানান, তাঁরাই চিঠি লিখে টাকা আটকে রাখতে আবেদন জানিয়েছেন। সেই থেকে গত তিন বছর ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ ছিল। বৃহস্পতিবার সেই নিয়েই কড়া নির্দেশ দিল আদালত।
এদিন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম পরিষ্কার ভাষায় বলেন, “কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে অনন্তকালের জন্য ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না।” আদালত জানিয়েছে, দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনে যে কোনও ধরনের শর্ত আরোপ করতে পারবে কেন্দ্র। শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ শর্তও আরোপ করা যাবে। কেন্দ্র চাইলে নির্দিষ্ট পোর্টালের মাধ্যমে সরাসরি ব্যক্তিবিশেষের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাক। জেলায় জেলায় নজরদারির পাশাপাশি, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্তও করাতে পারে। কিন্তু প্রকল্প আটকে রাখা যাবে না। ১ অগাস্ট থেকে রাজ্যে ফের ১০০ দিনের কাজ চালু করতে হবে।
১০০ দিনের কাজ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি। আইনজীবী বিকাশরঞ্জয় ভট্টাচার্য তাদের হয়ে এই মামলা লড়ছেন। অভিযোগ, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজের মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। মামলাকারীদের আবেদন, এখনও পর্যন্ত যা বকেয়া মজুরি, সেই টাকা অবিলম্বে মিটিয়ে দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে এত দিন টাকা বন্ধ করে রাখার জন্য ০.০৫ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হোক। এ ছাড়া, একই বিষয়ে হাই কোর্টে পৃথক মামলা করেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। সিবিআই তদন্তের আবেদনও জানান চান শুভেন্দু। ২০২৪ সালে পঞ্চায়েত এবং গ্রামীণ উন্নয়ন দফতরের সচিব হলফনামা দিয়ে জানান, ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রীয় দল ৬১৩ কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। তার মধ্যে রাজ্য ২১০.৩৫ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেছে। এর পর আদালতের নির্দেশে একটি চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়, যারা জেলা অনুযায়ী প্রকৃত উপভোক্তাদের তথ্য যাচাই করবে। কমিটিতে রাখা হয় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এক জন করে প্রতিনিধি। এ ছাড়া ক্যাগ (অডিটর অ্যান্ড কম্পট্রোলার জেনারেল) এবং অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের এক জন করে প্রতিনিধি এই কমিটিতে রাখা হয়।
গত তিন বছর ধরে কেন্দ্র ১০০ দিনের প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে বলে বরাবর অভিযোগ তুলে এসেছে তৃণমূল। বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরই রাজ্যের টাকা আটকে রেখে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। বিষয়টি নিয়ে সংসদেও সরব হন অভিষেক। টাকা দিয়ে থাকলে কেন্দ্র শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক বলে দাবি তোলেন তিনি। সেই আবহে রাজ্যের তহবিল থেকে শ্রমিকদের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। সেই মতো ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো শুরু করে রাজ্য। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপোড়েনে কেন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে থাকবে, কেন রাজ্যকে নিজের তহবিল থেকে টাকা দিতে হবে, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। চারটি জেলা থেকে দুর্নীতির অভিযোগ এলে, গোটা রাজ্যের টাকা কেন বন্ধ করা হল, তা নিয়ে আজও প্রশঅন ওঠে আদালত। কেন তিন বছরের বেশি সময় ধরে টাকা বন্ধ, ওঠে প্রশ্ন। এদিন আদালত সেই নিয়েই নিজের সিদ্ধান্ত জানাল।
এই রায়ের পর তৃণমূল বলছে তাঁদের দাবি মান্যতা পেল। তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়ে আমাদের সেই দাবি মান্যতা পেল যে, কেন্দ্রীয় সরকার বেআইনিভাবে, বৈষম্যমূলকভাবে, প্রতিহিংসাপরায়ণভাবে বাংলার টাকা বন্ধ রেখেছিল।”