ডা: মো: হাফিজুর রহমান (পান্না), রাজশাহী, বাংলাদেশ।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুই পক্ষের মধ্যে দন্দ্ব সৃষ্টি
তিরোভাব তিথি মহাউৎসবকে ঘিরে উত্তেজনা
দুর্নীতির তদন্ত ছাড়াও বহিরাগতদের বাদ দিয়ে স্থানীয়দের ট্রাস্টির সদস্য করার দাবি
গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ
বর্তমান কমিটিকে সরিয়ে নতুন কমিটি গঠন করার দাবি
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি মহাউৎসবকে ঘিরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আগামী ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টি বোর্ডের নেতৃত্ব নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুই পক্ষের মধ্যে দ›দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এতে উৎসব সুষ্ঠুভাবে আয়োজন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সোমবার (৬ অক্টেবার) কাকনহাটে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ শঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তারা অভিযোগ করেন, গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান পরিচালনা কমিটি দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টসহ কয়েকটি সংগঠন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। সেখানে তারা দুর্নীতির তদন্ত ছাড়াও বহিরাগতদের বাদ দিয়ে স্থানীয়দের ট্রাস্টির সদস্য করার দাবি তুলেছেন।
গোদাগাড়ী উপজেলা পূজা উদযাপন ফ্রন্ট কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজন পাল বলেন, “গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টের ম্যানেজার গোবিন্দ পাল দীর্ঘদিন ধরে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন। আমরা এর প্রতিবাদ করায় তার নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়।”
তিনি আরও বলেন, “গত ১২ জুন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রধান অতিথি হয়ে একটি অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল। তার আগের দিন আমরা সেখানে গেলে গোবিন্দ পালের লোকজন আমাদের ওপর হামলা করে। তারা মনে করেছিল, আমরা তাদের দুর্নীতি তথ্য ফাঁস করব।”
তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনাটি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীনের অনুসারীদের সহায়তায় ঘটানো হয়েছে। “আমরা চাই উৎসবের আগেই বর্তমান কমিটিকে সরিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হোক, নইলে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা আছে,” বলেন সুজন পাল।
বৈষ্ণবসৎ সংঘের সাধারণ সম্পাদক সহদেব কুমার পান্না জানান, গত ১২ জুন গৌরাঙ্গবাড়ী মন্দিরে গেলে গোবিন্দ পাল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী তার ওপর হামলা চালায়। “আমি প্রাণে বাঁচতে দৌড়ে পালাই। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন হামলা দুঃখজনক। যেখানে স্থানীয়রা নিরাপদ নয়, সেখানে বাইরের অতিথিরা কীভাবে নিরাপদ থাকবেন?”- প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রাজশাহী জেলা পূজা উদযাপন ফ্রন্টের আহ্বায়ক ও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের সভাপতি উপেন্দ্রনাথ মÐল বলেন, “গোবিন্দ পাল বহুদিন ধরে দুর্নীতি করে আসছেন। গত জুনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর রায়কে নিয়ে অনুষ্ঠানের আগেই তার লোকজন হামলা চালায়।’’
এই হামলার পেছনে বিএনপি নেতা শরীফ উদ্দীনের লোকজনও জড়িত দাবি করে তিনি অভিযোগ করেন, “শরীফ উদ্দীনের ছত্রছায়ায় বহিরাগত ট্রাস্ট্রির ম্যানেজার গোবিন্দ পাল এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে সে নিয়মিত ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে যাচ্ছে, আর কেউ কিছু বললে তার ওপর হামলা হয়।”
অন্যদিকে, অভিযোগ অস্বীকার করে গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টের ম্যানেজার গোবিন্দ পাল বলেন, “সব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এটি একটি ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।”
ট্রাস্টের সদস্য বিকাশ কুমার সরকার বলেন, “একটি পক্ষ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। উৎসব শান্তিপূর্ণ ভাবে পালনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।”
এদিকে, গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, “উৎসবকে ঘিরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না হয়, সে বিষয়ে প্রশাসন সতর্ক আছে। এটি গোদাগাড়ীর ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। তাই সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উৎসব পালনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

তিনি জানান, তিন দিনব্যাপী উৎসব ঘিরে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের সমাগম হবে। তাদের নিরাপত্তায় প্রায় ৫০০ সদস্যের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি স্যানিটারি ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো, তিনটি চিকিৎসা ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে।
১৬১১ সাল থেকে দুর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার মহান সাধক ঠাকুর নরোত্তম দাসের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে বছরে একবার মিলিত হয়ে থাকেন। তিন দিনের এ মহোৎসবে প্রতি বছর যোগ দেন দেশ-বিদেশের প্রায় ২০ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী। তবে এবার সেখানে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের সমাগম হতে পারে বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ।