সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“এটা বিচার বিবেচনা করে আইনের সংস্কার নয়। এটা ভারতের গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করার জন্য এটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কর্তৃত্ব। আমাদের সাংসদরা এই বিলের বিরোধিতা করবেন সংসদে। দিল্লি স্বৈরাচারী ইচ্ছার কাছে বাংলা মাথা নত করবে না। এই লড়াই ভারতের গণতন্ত্রকে স্বৈরাচারের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য।” দেশজুড়ে এক দেশ এক নির্বাচন চালু করার জন্য সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে বিল পেশ করার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সম্মতি জানানোর পরেই এভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাস হয়ে গেল ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ বিল। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার তরফ থেকে এই বিলে সিলমোহর দেওয়া হয়। যার প্রধান লক্ষ্য হল – সারা দেশে একইসঙ্গে সমস্ত নির্বাচনের আয়োজন করা। গত সেপ্টেম্বর মাসে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর উদ্যোগে সম্মতি জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। যাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, এই বিল আইনে পরিণত হলে আগামী দিনে সারা দেশে লোকসভা, বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত ও পৌর নির্বাচন , ১০০ দিনের সময়সীমার মধ্যে কার্যত একসঙ্গে মিটিয়ে ফেলা হবে। তবে এই বিলকে মানতে পারছে না বিরোধীদের অনেকেই। সুর চড়াচ্ছে তৃণমূল আপ।
তবে মোদী সরকারের যুক্তি, এই সিস্টেম কার্যকরী হওয়ার পরে একদিকে যেমন নির্বাচনের খরচ কমবে, তেমনই বারবার নির্বাচনী বিধিনিষেধ এবং আদর্শ আচরণ বিধি পালনের ঝক্কিও কমবে। সেক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কাজ করার সময় আরও বেশি পাওয়া যাবে বলেও দাবি করছে সরকার পক্ষ।
এক্স হ্যান্ডেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিরোধীরা সঙ্গত উদ্বেগ জানালেও এক দেশ এক ভোট বিল নিয়ে বুলডোজার চালাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এটা শুধু অসাংবিধানিক নয়, এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন, “এটি কোনও সুষ্ঠুভাবে বিবেচিত সংস্কার নয়; এটি একটি স্বৈরাচারী পদক্ষেপ, যা ভারতের গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।” তৃণমূলনেত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দলের সাংসদরা এই এই জনবিরোধী বিলটির কঠোরভাবে বিরোধিতা করবেন। তাঁর কথায়, “বাংলা কখনওই দিল্লির একনায়কতন্ত্রী সিদ্ধান্তের কাছে নত হবে না। এই সংগ্রাম ভারতের গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করার লড়াই!”
অন্যদিকে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল লিখেছেন, “দেশের প্রয়োজন এক দেশ এক শিক্ষা, এক দেশ, এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এক দেশ এক ভোট নয়। বিজেপির ভুল অগ্রাধিকার।”
তবে সংসদের অধিবেশনে এই বিল আদৌ অনুমতি পাবে কিনা, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বিমানবাবুর কথায়, “২ বছর আগে অল ইন্ডিয়া স্পিকার কনভেনশনে গিয়েছিলাম। লোকসভার, রাজ্যসভার ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। সেদিন ওরা একটা রেজুলেশন এনেছিলেন , ঠিক এই ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ভোটে’র আদলে। লোকসভার স্পিকারকে আমি তখনই ওই কথা বলি, উনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে মিস লিড করছেন। আমাদের এরকম কোনও পরিকল্পনা নেই। অথচ আমি দু’বছর আগে ঠিক এই আশঙ্কাটাই প্রকাশ করেছিলাম।”
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সেপ্টেম্বরে এই প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। বুধবার কোবিন্দ বলেন, “এক দেশ, এক ভোট উদ্যোগ একেবারেই জাতীয় স্বার্থে, এটি কোনও নির্দিষ্ট দলের জন্য নয়।” তিনি এও বলেন যে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশের জিডিপি ১ থেকে ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
কোবিন্দর এই দাবি খারিজ করে দিয়েছেন বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার বলেন, “জানি না সংবিধান থেকে এই বিল কতটা অনুমোদন পাবে। যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাঁরাই এই বিষয়টা নিয়ে বলতে পারবেন। তবে এটুকু বলতে পারি, আদালত আছে, বিষয়টা অনেকদূর গড়াবে।”
এর আগে কোবিন্দ কমিটিকে চিঠি দিয়ে মমতা তাঁর আপত্তির বিষয়গুলি এক দুই করে জানিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম প্রশ্ন হল, ‘এক দেশ’ বলতে কী বোঝাতে চাইছে মোদী সরকার? সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কিংবা ঐতিহাসিক পটভূমিতে এক দেশের তবু না হয় একটা অর্থ হয়। কিন্তু ভারতের সংবিধানের শর্ত অনুযায়ী এক দেশের অর্থ তাঁর কাছে বোধগম্য নয়।
মমতার এও প্রশ্ন, সংবিধানে কি ‘এক দেশ এক সরকারের’ নীতি অনুসরণ করার কথা বলা রয়েছে? তাঁর মতে, ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র। সংবিধানে সেই শর্তের কথা রয়েছে। কোথাও এক দেশ এক সরকারের কথা বলা নেই। এই মৌলিক বিষয়টি এড়িয়ে এক দেশ এক ভোটের কথা ভাবাই যায় না।
বাজপেয়ী জমানায় পর পর দু’বার কেন্দ্রের সরকারের পতন ঘটেছিল। তার ফলে সাধারণ নির্বাচন তথা লোকসভা ভোট অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, লোকসভার সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট করবেন কী করে? ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় থেকে কিছুদিন তা করা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য ও জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে সেই তালমিল ভেঙে গিয়েছে। তাঁর এও প্রশ্ন, যে সব রাজ্যে পাঁচ বছরের জন্য সরকার গড়তে মানুষ ভোট দিয়েছে, এক সঙ্গে ভোট করাতে গেলে সেখানে সরকার ভেঙে দিতে হবে। তা হয় নাকি!
তৃণমূলনেত্রীর কথায়, রাজ্যস্তরে নির্বাচনের বিষয়আশয় এক রকম থাকে। জাতীয় স্তরে থাকে অন্যরকম। এক সঙ্গে ভোট করাতে গেলে এই ফারাকটা থাকবে না। কোনও ভাবে জাতীয় স্তরের বিষয় দিয়ে রাজ্যের ভোট করানো যায় না।