সুষমা পাল মন্ডল। কলকাতা সারাদিন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বিড়লা গোষ্ঠীর নতুন রঙের কারখানার উদ্বোধন ঘিরে এক বড়সড় নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করার মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাতিল হয়ে গেল এই বহু প্রতীক্ষিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মমতা অভিযোগ করলেন, “আমার তো মনে হয়, এটা হাইলোডেড ভাইরাসের কাজ! সবাইকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভয়ানক ব্যাপার!”
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যে রাজনৈতিক মহল সরগরম। মমতার দাবি, এটা শুধুমাত্র এক জনের অসুস্থতার কারণ নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে এক গভীর ষড়যন্ত্র।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বিস্ফোরণ
আজ কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “গতকাল প্রেস কনফারেন্স থেকে আমি বলেছিলাম, বৃহস্পতিবার বিড়লা ওপাসের রঙের কারখানা উদ্বোধন করব। সেই কথা বলার আধ ঘণ্টার মধ্যে আমার কাছে বার্তা এল, ওই কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “ওদের এক জনের শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আপাতত বাতিল করেছে। আমি ওদের দোষ দিতে চাই না। কিন্তু বুঝেছি, এর পিছনে হাইলোডেড ভাইরাস রয়েছে। সবাইকে থ্রেট করছে।”
মমতা সরাসরি বিজেপির নাম না করলেও ইঙ্গিত স্পষ্ট — এই ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক চাপ বা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ থাকতে পারে।
বিজেপি শাসিত কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন মমতা
বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী তীব্র ভাষায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান। তাঁর বক্তব্য, “অনেক সরকার দেখেছি, কিন্তু এরকম ভয়ানক সরকার আমি আগে কখনও দেখিনি। এরা তো দেশটাকে পুরো শেষ করে দেবে। বেশি দম্ভ ভাল নয়। মনে রাখবেন, কোনও কিছুই স্থায়ী নয়।”
তিনি আরও বলেন, “এ সব অমিত শাহের খেল! অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টারের কাজ করছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলব, দেখবেন উনিই একদিন আপনার মীরজাফর হবেন।”
রাজনৈতিক মহলে মমতার এই মন্তব্য নতুন করে বিতর্ক ছড়িয়েছে। অনেকের মতে, বিড়লা ওপাস প্রকল্পের উদ্বোধন বাতিল হওয়া শুধুই প্রশাসনিক কারণ নয় — এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক চাপ ও অদৃশ্য শক্তির প্রভাব।
বাংলায় বিড়লা ওপাসের বিনিয়োগ
বিড়লা গ্রুপের এই রঙের কারখানা তৈরি হচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরের কাছে প্রায় ৮০ একর জমির ওপর। প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা, যা রাজ্যে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
কোম্পানির তরফে জানানো হয়েছে, এই কারখানা চালু হলে প্রায় ২,০০০ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বিড়লা গ্রুপ রাজ্যে আরও বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে — যার মধ্যে রয়েছে আল্ট্রাটেক সিমেন্টের নতুন গ্রাইন্ডিং ইউনিট, যা চালু হলে তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা বছরে ১ কোটি ১০ লক্ষ টন ছাড়িয়ে যাবে।
এই প্রজেক্ট নিয়ে রাজ্য প্রশাসনও ছিল আশাবাদী। কিন্তু উদ্বোধন বাতিলের ঘটনায় নতুন প্রশ্ন উঠে পড়েছে — বড় কর্পোরেট হাউস কি রাজনৈতিক চাপে নত হচ্ছে?
আগেও বারবার শেষ মুহূর্তে বাতিল অনুষ্ঠান
এই প্রথম নয়, অতীতে বহুবার এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে রাজ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদেশ সফর বা জাতীয় স্তরের সম্মেলনে উপস্থিতি শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়েছে নানা অজুহাতে।
চীনের উপরাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সফর বাতিল হয় বিদেশ মন্ত্রকের নির্দেশে।
পোপের উপস্থিতিতে রোমে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ থেকেও শেষ মুহূর্তে সরে যেতে হয়।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও শিকাগোর আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণও শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
এই সমস্ত ঘটনার পেছনে ‘কেন্দ্রীয় চক্রান্ত’-এর গন্ধ পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বহুবার। এবারও বিড়লা প্রকল্পের উদ্বোধন বাতিল হওয়ায় সেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রভাব না প্রযুক্তিগত অজুহাত?
বিড়লা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান “অসুস্থতার কারণে সাময়িকভাবে স্থগিত” করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে “হাইলি লোডেড ভাইরাস” মন্তব্য করে যে দিক নির্দেশ করেছেন, তা কেন্দ্রীয় স্তরে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক চাপের দিকে ইঙ্গিত করছে।
একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন —“যদি কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেন, শিল্প উদ্বোধন বন্ধ হয়েছে হাইলি লোডেড ভাইরাসে, তাহলে সেটা নিছক প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক কূটনীতি রয়েছে।”

বাংলায় শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বহুবার বিদেশ সফর করেছেন, বিনিয়োগ সম্মেলন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে বড় কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বারবার জটিল হয়ে পড়েছে। বিড়লা ওপাসের উদ্বোধন বাতিল সেই তালিকায় নতুন সংযোজন।
“সবাইকে থ্রেট করছে, ভয়ানক ব্যাপার”— মুখ্যমন্ত্রীর এই কথায় শুধু হতাশা নয়, শাসকদলের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভের ইঙ্গিতও লুকিয়ে আছে।
এক হাজার কোটির বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রকল্পটি কবে উদ্বোধন হবে, তা এখন সময়ই বলবে। তবে আপাতত রাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্গন জুড়ে একটাই প্রশ্ন— ‘হাইলি লোডেড ভাইরাস’ ঠিক কাদের লক্ষ্য করছে?