সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
“বাংলার আলু কেন বাইরে চলে যাচ্ছে? জিনিসপত্রের দাম.. শীতকাল আসছে। অবিলম্বে টাস্ক ফোর্সের মিটিং করা হোক। আলু আর পেঁয়াজের দামটা কেন বাড়াচ্ছে? আমরা বলেছিলাম, আমাদের যা প্রয়োজন রাজ্যে, সেটাকে রেখে নতুন আলু যতক্ষণ না উঠছে, ততক্ষণ বাইরে আলুটা যাবে না। এখন তো দেখছি এরা এক্সপোর্ট করতে শুরু করে দিয়েছে। কোন পজিশনে আছে, আমাকে জানাতে হবে। নজরদারি করতে হবে।” গত কয়েক মাস ধরে বাজারে যেভাবে আলু পেঁয়াজের দাম অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় শাক সবজির পাশাপাশি অত্যধিক হারে বেড়ে গিয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে এবারে নবান্ন সভা ঘরে জরুরী বৈঠকে এমন নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বৃহস্পতিবার আলু ও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি নিয়ে টাস্ক ফোর্সের মিটিং ডাকারও নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। সীমান্ত সিল করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। বাংলায় আলুর দাম বৃদ্ধি নিয়ে কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলায় আলুর দাম বাড়িয়ে অন্য রাজ্য বা জায়গা থেকে মুনাফা কামাবে। আর আমি চাষিদের জন্য ইনসিওরেন্সের ব্যবস্থা করব, দুটো জিনিস একসঙ্গে চলতে পারে না। এই জিনিস আমি বরদাস্ত করব না। তিনি আরও বলেন, বাংলা থেকে আলু ছেড়ে ছিলাম। বলে ছিলাম রাজ্যের প্রয়োজন মিটিয়ে তারপর বাইরে আলু ছাড়তে। কিন্তু কী দেখলাম? বাংলায় আলুর দাম বাড়িয়ে ভিন রাজ্যে আলু পাঠিয়ে বাড়তি মুনাফা লুটার চেষ্টা! এটা তো বরদাস্ত করব না।”
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, ‘সীমানা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার নিয়ন্ত্রণ কর। তার আগে স্টক আমাকে দেখাবে। কত ছিল, কত বেরিয়েছে, এখন কত আছে’। বলেন, ‘আমাদের স্টকটা তো রেখে দিতে বলেছিলাম জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের স্টকটা। শুধু বীজের জন্য় আলু যেটুকু লাগে, সেটুকু রেখে। কেন এটা হল? আমাকে কেন জানানো হল না? আমি বলেছিলাম এক লক্ষ করে করে আমি ছাড়ব। ছাড়তেও শুরু করেছিলাম। যতটা পেরেছে নিয়ে নিয়েছে’।
এদিনের বৈঠকে প্রথমে উপস্থিত ছিলেন না রাজ্য পুলিসের ডিজি রাজীব কুমার। তাঁকে ডেকে পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। ডিজিকে বলেন, ‘হয়তো তুমি চেষ্টা কর, কিন্তু স্থানীয় পুলিস সহযোগিতা করছে না। সবাইকে বলছি না আমি, একাংশ। রাজনৈতিক নেতাদের নামে সবাই বদনাম করে বেশি। ৫ টাকা খেলে ৫০০ টাকা বলে দেয় চোর। রাজনৈতিক নেতারা টাকা খাওয়ার আগে দশবার ভাবে। জনগণের টাকা খাওয়া কি উচিত! তাঁদের নিজস্ব দায়বদ্ধতাও থাকে। কিন্তু নিচুতলার কিছু অফিসার, কিছু কর্মী, যাঁরা এই সরকারকে ভালোবাসে না। এবং পুলিসেরও কিছু লোক, তাঁরা টাকা খেয়ে বালিচুরি বল, কয়লাচুরি বল, সিমেন্ট চুরি বল…’
মমতা বলেন, ‘চুরি হলে তখন বলবে কয়লা চুরি করছে তৃণমূল কংগ্রেস আর চুরি করবে সিআইএসএফ টাকা খেয়ে বা পুলিশের একাংশ টাকা খেয়ে আমি এটাকে টলারেট করব না। যদি কোনও রাজনৈতিক দলের লোকও খায় তার কলার চেপে ধরো। তাকে আইনের প্যাঁচে ধরো। আইনত জেলে পাঠাও। এখানে কোনও অজুহাত আমি শুনতে চাই না।’ নবান্নের সভা ঘরে সাংবাদিক বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কয়লা চুরি করবে সিআইএসএফ, পুলিশের একাংশ আর দোষ হবে তৃণমূলের? এ জিনিস আমি টলারেট করব না।”
মমতার দাবি, ‘আমার দরকার নেই এক পয়সাও। বার বার আমি বলি। প্রয়োজনে আমি দলের নির্বাচন করানোর জন্য লোকের কাছে আঁচল পেতে টাকা নেব। আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না কোনও সরকারের কাছ থেকে বা কারও কাছ থেকে আমি এক পয়সা নিয়েছি। কোনও কারণে। অন্য কেউ যদি নিয়ে থাকে তুমি ছাড়বে কেন? প্রত্যেকের জন্য আইন সমান ভাবে কার্যকর হওয়া উচিত। সেখানে কোনও বৈষম্য হওয়া উচিত নয়। কেউ কেউ ভাবে, একে ম্যানেজ করি, ওকে ম্যানেজ করি। করে তোলাবাজি করি। তারা বাঁচাবে। কেউ বাঁচাবে না। আমি তো বাঁচাব না। আমার কাছে কোথাও না কোথাও থেকে তো খবর আসবেই।’
নবান্নের সভাঘরে সাংবাদিক বৈঠক থেকে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জয়গাঁতে এত পাথর পড়ে রয়েছে। তোমরা কেন টেন্ডার করছো না। এটা তো ভূমি দফতরের কাজ। তারা চুপ করে বসে আছে। যত বালির জায়গা আছে, পাথরের জায়গা আছে টেন্ডার করে দাও। বেআইনি কয়লা খাদান বন্ধ করো- একথা তো আমি অনেক আগেই বলেছি। সিআইএসএফ টাকা খেলেও তাকে ধরবার অধিকার আছে তোমাদের। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে?”
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজনৈতিক নেতা ৫টাকা খেলে বলা হয় ৫০০ টাকা খেয়েছে। নেতারা টাকা খাওয়ার আগে তবু দশ বার ভাবে। তাদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। নীচুতলার কিছু অফিসার এবং পুলিশের কিছু লোক, যারা সরকারকে ভালবাসে না, তারা এসব নিয়ে ভাবে না। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থটা দেখে।”
আলু রপ্তানি প্রসঙ্গে মমতা আরও জানালেন, ”যদি বলে তৃণমূলের নেতারা টাকা খাচ্ছে, আমি দরকার হলে লোকেদের কাছে আঁচল পেতে টাকা নেব। আইন সবার জন্য সমান ভাবে কার্যকর হবে। আলুর দাম বাড়ছে। পেঁয়াজ কষ্ট করে তৈরী করছি। এগ্রিকালচার ও রুরাল মিনিস্ট্রিকে বড়ো বড়ো কথা বললে হবে না। দানার সব সার্ভে হয়ে গেছে? সারা বছরই তো ইলেকশন। তাহলে তো কাজ হবে না।”
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, ”লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প বাংলা প্রথম শুরু করেছে। এখন বাংলা মডেল হয়ে গেছে। সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীতে (মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব পোর্টাল) ২৪ হাজার আবেদন পেয়েছিলাম। আমরা আগামী ডিসেম্বর মাসে ৫ লক্ষ ৭ হাজার মহিলাকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে যুক্ত করা হল। ৬২৫ কোটি টাকা আরও বেশি খরচ হবে। অন্যান্য রাজ্যে অনেক নিয়মাবলী আছে। আমার রাজ্যে নেই। একটি বাড়িতে ৪ জন মহিলা থাকলেও পায়। আমাদের ২ কোটি ২১ লক্ষ মহিলা পাবে লক্ষ্মী এর ভান্ডার। দেখান তো কোনো রাজ্যে এত সংখ্যা আছে কিনা।”
বিধবা ভাতার ক্ষেত্রেও বাড়বে সংখ্যা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিনের বৈঠকে জানালেন, ”৪৩৯০০ বিধবা মহিলাদের নতুন করে ডিসেম্বর মাস থেকে বিধবা ভাতা দেওয়া হবে। এর জন্য রাজ্য সরকারের খরচ ৩ হাজার কোটি হয়ে যাবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ”কৃষক বন্ধু ২৪-২৫ রবি মরসুম এর জন্য ১ কোটি ৮ লক্ষ ৯৫ হাজার কৃষককে মোট ২৯৪৩ কোটি টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল। আগামীকাল থেকে টাকা যাবে। এই বছর মোট ৫২৮৯ কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হল। টাকাটা সম্পূর্ণ রাজ্যের। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের কোনও টাকা নেই।”
বিগত কয়েকদিন ধরেই ট্যাবকাণ্ডে তোলপাড় গোটা রাজ্য়। অ্যাকাউন্টে ঢোকার আগেই গায়েব শ’য়ে শ’য়ে পড়ুয়ার ট্যাব কেনার টাকা। উদ্বেগের রাজ্যের সিংহভাগ জেলাতেই। মাঠে নেমেছে পুলিশ। জেলায় জেলায় চলছে ধরপাকড়। যদিও যাঁদের ট্যাবের টাকা গায়েব হয়েছে তাঁদের কাছে ফের দ্রুত টাকা পৌঁছে যাবে বলে আগেই আশ্বস্ত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন সাংবাদিক বৈঠক থেকে মমতা সাফ বলেন, “রাজীব জেলায় জেলায় নির্দেশ দিয়ে দাও। প্রতি জেলায় একজন করে নোডাল অফিসার থাকবে। টাস্ক ফোর্সের বৈঠক করো। ১৬০০ কোটি টাকার ট্যাব আমরা দিই। ১৯০০-র মতো অ্যাকাউন্ট ফ্রড হয়েছে। জামতাড়া গ্যাং সকলের সঙ্গে মিশছে।” পুরো পরিস্থিতির উপর নজরদারি আরও বাড়ানোর পক্ষেই জোরালো সওয়াল করেন মমতা।
নাম না করে বাংলাদেশের অস্থির পরিস্থিতির প্রসঙ্গ মনে করালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ প্রসঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষার প্রশ্নে কেন্দ্রের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করলেন। এরপরই জানিয়ে দিলেন, “এখন থেকে সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা নাকাচেকিং হবে, কেউ ভুল বুঝবেন না।” মমতা এও বলেন, “নাকা চেকিং মানে শুধু রাতে নয়, দিনেও নাকা চেকিং দরকার আছে। রেলেও নাকা চেকিং দরকার আছে।” এ ব্যাপারে রেলের জিএমদের নিয়ে মুখ্যসচিবকে বৈঠক করার কথাও বলেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রেল, বিমান এগুলো তো আমাদের হাতে নেই। ফলে সীমান্তে কেন্দ্র সক্রিয় না হলে তো সমস্যা। বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়তি সতর্কতা নিতে হচ্ছে।”
মমতার কথায়, “আমি এখন থেকে শপিং মলগুলোকে সাবধান হতে অনুরোধ করব। কিছু কমপ্লেন পেয়েছি। যেখান থেকে জাল নোট আসছে। জনগণকেও সাবধান হতে বলব। এসব জায়গায় এসে এরা শেল্টায় নেয়।”
তিনি দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে দেন বার্তা। একইসঙ্গে আবাস যোজনার বাড়ি তৈরি নিয়ে এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নিজের নামে প্রোগ্রাম এটা সাপোর্ট করি না। কিন্তু আমি যখন কথা দিই, আমি সেটা করে দিই। আমার দায়বদ্ধতা মানুষের কাছে। তারপর দলের কাছে। এটা বাংলার বাড়ি হবে। টাকাটা যখন আমরা দিচ্ছি তখন আমাদের নামেই হবে। সুফল বাংলা আরও বাড়াতে হবে।”
মমতা বলেন, “৩৬ লক্ষ মাটির বাড়ি আছে আমি যতদূর জানি। অনেকে আছে সার্ভের নামে একটা পাকা দেওয়াল থাকলে তুমি তাহলে বাদ দেবে কেন? গ্রামে আমি গিয়েছি। সাঁতার কাটতে জানি, পাঁচিলে উঠতে জানি। ক্লাস ৭ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়ে গেলে গ্রামে যেতাম আমি। আমরা বলেছিলাম ১১ লক্ষ বাড়ি দেব। সেটা আরও ১ লক্ষ বাড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের সরকার ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ৩০-এ ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা দিতে শুরু করবে। ১২ লক্ষ দেওয়ার পরেও আমাদের আরও বাকি থাকবে ২৪ লক্ষ। আরও ধাপে ধাপে যখন টাকা আসবে, তখন দেব। আরও ২৪ লক্ষ দিতে দু-তিন বছর সময় নেব। সারা বাংলায় পাকা বাড়ি করে দেব। টাকাটা জোগাড় করতে হবে।”