সুমন তরফদার। কলকাতা সারাদিন।
ওয়াকফ সম্পত্তি শুধুমাত্র কোন একটি জায়গার বিষয় নয়। সুদীর্ঘকাল ধরে দেশের প্রত্যেকটি প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে ওয়াকফ সম্পত্তি। তাই শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে আইন করে তা চাপিয়ে দিতে পারে না সকলের উপরে। ওয়াকফ সম্পত্তি কে বা কারা দান করতে পারে এবং সেই দানের বৈধতা কতখানি তা প্রথমে নির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করবে দেশের সমস্ত রাজ্য সরকার। তারপরেই তা চালু হতে পারে দেশ জুড়ে। এভাবেই কেন্দ্রের মোদি সরকারের একতরফাভাবে চালু করা ওয়াকফ আইনে আংশিক স্থগিতাদেশ জারি করে নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাইয়ের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ।
দেশের সমস্ত ভাজপা বিরোধী রাজনৈতিক দল শাসিত রাজ্য সরকার এবং প্রায় সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাংসদদের তীব্র বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে গত বছর ৮ আগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিলটি উত্থাপিত হয় এবং ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল লোকসভায় এবং ৪ এপ্রিল রাজ্যসভায় পাস হয়। এই বিলে ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই আইনের অধীনে ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালিত হয়, যেখানে ওয়াকফের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে- ধর্মীয় বা জনহিতকর কাজের জন্য মুসলিম আইন অনুসারে দানকৃত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি। ওয়াকফ ব্যাবস্থাপনার জন্যে প্রতিটি রাজ্যেই ওয়াকফ বোর্ড গঠন করা হয়। লোকসভায় ২৮৮ সদস্যের সমর্থন নিয়ে ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল পাস হয়, যেখানে ২৩২ সাংসদ এর বিপক্ষে ছিলেন। রাজ্যসভায় এর পক্ষে ভোট দেন ১২৮ এবং বিপক্ষে ভোট দেন ৯৫ জন।
একই দিনে নজিরবিহীন অতিতৎপরতার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫ নামকরণ করা হয়। তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেও দেশ জুড়ে যাতে এখনই এই বিলকে আইন হিসেবে কার্যকর না করা হয় তেমন দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে একের পর এক মুসলিম সংগঠন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। ২০২৫ সালে পাশ হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল সম্পূর্ণভাবে স্থগিত করার আবেদন জানানো হলেও ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫-এর কয়েকটি ধারার কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত করল সুপ্রিম কোর্ট।
তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মমতা
সুপ্রিমকোর্ট আজ ওয়াকফ আইনের কয়েকটি ধারার উপরে স্থগিতাদেশ দিয়ে যেভাবে দেশের রাজ্য সরকার গুলির অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে তা কার্যত এই আইন পাশের পরের তিনি বলেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বাংলায় যে এই আইন একতরফা ভাবে চালু করা যাবেনা, সেই হুশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেছিলেন, আমি জানি ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে সংখ্যালঘুদের মনে একটা দুঃখ আছে। আপনারা ভরসা রাখুন, বাংলায় এমন কিছু হবে না যাতে বিভাজন হয়। সবাইকে একসঙ্গে থেকে বাঁচতে হবে। কেউ কেউ রাজনৈতিক প্ররোচনা দেয়। আমি বলছি, দিদি আছে, দিদি আপনাদের রক্ষা করবে। আপনাদের সম্পত্তি রক্ষা করবে। কেউ উস্কানিতে পা দেবেন না। আমরা ওয়াকফ আইনকে সমর্থন করি না। যাঁরা উস্কানি দিচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেব।
কোন কোন ধারা স্থগিত সুপ্রিম কোর্টের
আজ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মাসিহ-এর বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, গোটা আইন স্থগিত করার কোনও ভিত্তি নেই, তবে কয়েকটি বিতর্কিত ধারা আপাতত কার্যকর হবে না। প্রথমত, ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধে জেলা শাসকের কোনও ভূমিকা থাকবে না। এই অধিকার এখন কেবলমাত্র ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল বা হাইকোর্টের হাতে থাকবে। পাশাপাশি, রাজস্ব রেকর্ড সম্পর্কিত বিধানও স্থগিত করা হয়েছে। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনও তৃতীয় পক্ষ ওয়াকফ সম্পত্তির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল তা হল কেন্দ্রীয় সরকার আইন সংশোধন করে ওয়াকফ সম্পত্তির সংজ্ঞা বদল করে দাবি করেছিল। কোন ব্যক্তি যদি নিজের সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে দান করে থাকেন তাহলে তাকে অন্তত পাঁচ বছর ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে জীবন কাটাতে হবে। এখনই পাঁচ বছর ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া ব্যক্তির ওয়াকফ সম্পত্তি প্রদানের আইনের খারিজ হচ্ছে না। রাজ্যগুলি নিজেদের আইন তৈরি করার পরে এই আইন লাগু হতে পারে।
তৃতীয়ত, ওয়াকফ বোর্ডের কাঠামো সম্পর্কেও নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে সর্বাধিক চারজন এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে সর্বাধিক তিনজন অ-মুসলিম সদস্য থাকতে পারবেন। তবে ধারা ২৩ অনুযায়ী, পদাধিকারবলে যে কর্মকর্তারা থাকবেন, তাঁদের অবশ্যই মুসলিম সম্প্রদায়ের হতে হবে। সিইও নিয়োগ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, যতদূর সম্ভব এই পদে একজন মুসলিমকে নিয়োগ দেওয়া উচিত।